রোনালদো দৌড়াচ্ছেন, মেসি হাঁটছেন। কিন্তু দৌড়েও পারছেন না পর্তুগীজ সুপারস্টার, রিয়াল সোসিয়াদাদের ডিফেন্ডার তাঁকে সহজেই আটকে দিচ্ছেন। হতাশা ও ক্রোধের সংমিশ্রণ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফরোওয়ার্ডের মুখে খেলা করে যাচ্ছে।
অপর দিকে মেসি হাঁটছেন বটে, কিন্তু হাঁটছেন মাঠ জুড়ে। কখনো নেমে আসছেন ডিফেন্সিভ লাইনের কাছে, কখনো পেনাল্টি বক্সের বাইরে অবাধ বিচরণ করছেন। ফুটবলটা তাঁর পায়ে চুম্বকের মত লেগে থাকছে, সহজাত ড্রিবলে ডিফেন্ডারকে ছিটকে দিচ্ছেন।
শেষে লিও টুক করে বলটা চিপ করে ফেলে দিলেন সতীর্থ নেইমারের পায়ের ডগায়। প্রতীক্ষিত গোল এল। লিগ আর গুরুত্বপূর্ণ খেলায় প্যারিস সাঁ জাঁরমা আরেকটি জয় পেয়ে গেল। ব্রেশট কে হারিয়ে তারকাখচিত প্যারিস দল লিগ টেবিলের শীর্ষে নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে পারল।
রোনালদো ও মেসিকে একে অপরের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে আজন্মকাল। আরও কিছু দিন চলবে এই তুলনা। এই প্রজন্মের সেরা দুই ফুটবলার তাঁদের ক্যারিয়ার-সায়াহ্নে প্রবেশ করেছেন কয়েক মৌসুম হল।
দুনিয়ার প্রায় সব কিছুর মতই পেশাদার ফুটবল এক নিষ্ঠুর জগৎ। হয়ত চারপাশের পৃথিবীটার থেকে আরও বেশি। এই জগৎটার কে অতীতে ক’টা ব্যলঁ’দি’ওর পেয়েছে, ক’খানা গোল দিয়েছে, কতগুলো ট্রফি জিতেছে সেই ইতিহাসের কচকচিতে ঢুকতে চায় না, তুমি এই মুহূর্তে মাঠে কী দিতে পারছ এটাই আসল। সেই মাপকাঠিতেই এই মুহূর্তে রোনালদো ও মেসির বর্তমান কে মাপা হচ্ছে। তাঁরা কী লেগাসি রেখে যাবেন তা নিয়ে ভাবার সময় নেই ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলির। পারফর্মেন্সই একমাত্র কথা।
কিছুদিনেই রোনালদো বনাম মেসি তর্কটা আমরা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাব। হয়ত পরের নিরর্থক আলোচনাটা হবে হাল্যাণ্ড শ্রেষ্ঠ না এমবাপ্পে এই নিয়ে। নিরর্থক বলছি কারণ এই তর্কের যে কোন শেষ নেই, কিন্তু নিরর্থক হলেও খেলাধুলার জগতকে প্রাণবায়ু দেয় এ ধরণের আলোচনা। এবং তাঁদের অতুলনীয় ক্রীড়া জীবনের শেষ লগ্নে এসে প্রথমবার যেন মনে হচ্ছে দুই মহাতারকার পারফর্মেন্সকে আলাদা করা যাচ্ছে।
রোনালদো ও মেসি এক গোত্রের ফুটবলার হলেও খেলার ধরণে এক্কেবারে আলাদা যে। তাঁদের নিজেদের তৈরি করার প্রক্রিয়াটাও আলাদা ছিল প্রথম থেকেই। এই পর্যন্ত পড়ে কেউ-কেউ বলতে পারেন, এক্কেবারে আলাদা কথাটি কি ঠিক হল?
দুজনেই, প্রচুর গোল করেন, সতীর্থদের দিয়ে গোল করান, ড্রিবলের জাদুতে ফুটবল মাঠে মহামানব হয়ে ওঠেন এক নিমেষেই। কিন্তু তাও যে তাঁরা সম্পূর্ণ আলাদা। মেসি যে সহজাত প্রতিভা ও ফুটবল মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মেছিলেন সেগুলিকেই তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করে তুলেছিলেন তাঁর প্রাণের প্রিয় নিউ ক্যাম্পে, বার্সেলোনার আঁতুড় ঘরে। সেখান থেকেই পৃথিবীর সেরা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
রোনালদোর ফুটবল প্রতিভা ছিল না এ কথা বলার ধৃষ্টতা করব না, কিন্তু তাঁকে সেই প্রতিভার বীজকে ফুঁটিয়ে তুলতে হয়েছে অমানুষিক শ্রমের মাধ্যমে, শারীরিক কসরতের মাধ্যমে। তিনি সেরার-সেরা হয়ে উঠেছিলেন ইচ্ছা-শক্তির বলে এ কথা বলা যেতেই পারে। এ জন্য ক্রিস্টিয়ানো শুধু ফুটবল স্কিল তৈরি করার পেছনে খাটেননি, তৈরি করেছেন তাঁর শরীরকেও।
এখনও তাঁর পুরনো লাফের ভিডিও দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এই ৩৭ বছর বয়সেও একই রকম পরিশ্রম করে চলেছেন তিনি। বাড়িতে সব রকম ব্যবস্থা রেখেছেন যাতে আরও কয়েক বছর খেলাটির শিখরে থাকতে পারেন।
এর ফলে বলা যেতে পারে রোনালদো মেসির থেকে আরও কমপ্লিট এট্যাকার হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর গতি, তাঁর হেডিং ক্ষমতা বা তাঁর পাওয়ার মেসিকে ছাপিয়ে যায়। কিন্তু বয়স কাউকে ক্ষমা করে না, দেরি করলেও এসে জানান দেয় একদিন।
আর এখানেই মেসির সহজাত প্রতিভা তাঁর হাতে তুরুপের তাসটি তুলে দিয়েছে যেন। মেসি ফুটবল মাঠে যে ম্যাজিকটা তৈরি করতে পারেন তার জন্য রোনাল্ডোর মত পিক ফিটনেস লাগে না। আলতো টাচ, বিদ্যুৎ গতির মুহূর্তের টার্নে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে দিতে পারেন। এই ৩৫ বছর বয়সেও সেই সুতো টানার কাজটা তিনি সানন্দে করে যাচ্ছেন প্যারিসের হয়ে। সঙ্গে এম্বাপ্পে, নেমার, আচরাফ হাকিমির মত তারকা থাকায় তিনি যেন আরও মেলে ধরতে পারছেন তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে।
অন্য দিকে, দু’বছরের বড় রোনালদো আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারছেন না। গ্রিক গডের মতন দেহ সৌষ্ঠব তাঁর আছে এখনো, কিন্তু গতি তাঁকে বিদায় জানাচ্ছে যেন। এখনও হেডে রয়েছে সেই মরণ কামড়, কিন্তু সব সময় সেও সঙ্গ দিচ্ছে না। নতুন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ এরিক টেন হাগের হাই-প্রেস সিস্টেমে ৩৭-এর রোনালদোকে বেমানান লাগছে যেন। নিয়তির খেলা ছাড়া কি বলবেন একে? যে কোঁকড়া চুলের দ্রুতগতি উইঙ্গার এক যুগ আগে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড আলোকিত করতেন, তিনিই পিছিয়ে পড়ছেন খেলার লয়ের থেকে।
রোনালদোর জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল ছেলেবেলা থেকে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হওয়া। কিছুটা কি স্বার্থপর তিনি বরাবরই? প্রিয় ইউনাইটেড চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সুযোগ না পাওয়ায় হন্যে হয়ে অন্য ক্লাব খুঁজলেন এই প্রতিযোগিতার রেকর্ড গোলদাতা, অথচ নিজের আকাশচুম্বী মাইনে এক টাকাও কমাতে রাজি হলেন না।
নিজের লেগ্যাসি রক্ষা করা, বর্ধন করাই যেন পর্তুগীজ কিংবদন্তির মূল লক্ষ্য। যুগ এভাবেই পাল্টায় , রোনাল্ডোর মত তারকাকে কোন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ক্লাব নিতে চায় না, বা পারে না, তিনি কিছুটা ব্রাত্য হয়েই পড়ে থাকেন ইউনাইটেডে।
মেসি কিন্তু বাকি তারকাদের মাঝেও পিএসজিতে উজ্জ্বল, মধ্যমণি না হলেও নবরত্নের অন্যতম নি:সন্দেহে। এই শেষ লগ্নে কী তাহলে আর্জেন্টিনীয় তারকাই বাজিটা মেরে গেলেন? কিন্তু, রোনালদো যে সে ফুটবলার নন। পায়ের জোরের মতই মনের জোর তাঁর, সামনে বিশ্বকাপও রয়েছে যে, আরেকবার কি তিনি চেষ্টা করবেন না চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দিতে?