প্রতিপক্ষের স্কোরবোর্ডে সাড়ে তিনশো রানের পাহাড়সম সংগ্রহ। এর মধ্যে এক ওপেনার আবার ব্যক্তিগত ডাবল সেঞ্চুরিতে বোলারদের উপর রীতিমত তাণ্ডব চালিয়েছে। জবাবে ১৩১ রানেই নেই ৬ উইকেট। কার্যত, ম্যাচটা সেখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। সম্ভাব্য একপেশে এক ম্যাচের দিকেই ধাবিত হওয়ার কথা। কিন্তু ভারত-নিউজিল্যান্ড ম্যাচে এমন দৃশ্যপট আচমকায় বদলে গেল মাইকেল ব্রেসওয়েলের সৌজন্যে।
মিশেল স্যান্টনারকে নিয়ে তিনি ভারতের দেওয়া পাহাড়সম লক্ষ্যের পথে ছুটলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পারলেন না। কিন্তু ভারতীয় সমর্থকদের জন্য বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যা প্রয়োজন তার সবটাই মিটিয়েছেন দুর্দান্ত এক ইনিংসে। নিউজিল্যান্ডকে ম্যাচে ফিরিয়েছেন। প্রায় একপেশে হতে যাওয়া ম্যাচটাতে সবার চোখ রাখতে বাধ্য করেছেন ইনিংসের শেষ ওভার পর্যন্ত।
নিউজিল্যান্ডের হয়ে মাইকেল ব্রেসওয়েলের যাত্রাটা খুব বেশি দিনের নয়। এই গত বছরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছেন তিনি। তার আগে অবশ্য দীর্ঘ ১০ বছরের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর নামের পাশে। তারপরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত তিনি আনকোরাই বটে।
তবে ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে ব্যাটিংয়ে ছাপ রাখলেন একদম পরিণত এক ব্যাটারের মতো। ৭৮ বলে খেললেন ১৪০ রানের ইনিংস। তাতে ১২ চারের পাশাপাশি হাঁকিয়েছেন ১০ টি ছক্কা।
মাইকেল ব্রেসওয়েলের ক্যারিয়ার বেশ বিচিত্রতায় ঠাঁসা। মিডল অর্ডারে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল করেন। আবার মাঝে মধ্যে উইকেটকিপিংও করে থাকেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়েলিংটনের হয়ে একটা সময় পর্যন্ত নিয়মিতই উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ওটাগো, ওয়েলিংটন হয়ে এবার ব্রেসওয়েল নিজের মুনশিয়ানা দেখালেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
বাইশ গজে ব্রেসওয়েলের পা রাখার নেপথ্যে তাঁর পরিবারের ভূমিকায় বেশি। হবেই বা না কেন? ব্রেসওয়েলের পরিবারকে মস্ত বড়ো এক ক্রিকেট পরিবার বললেও ভুল হয় না। ভারতের বিপক্ষে এই সিরিজের দলেই আছে তাঁর চাচাতো ভাই ডাউগ ব্রেসওয়েল। মাইকেল ব্রেসওয়েলের বাবা নিজেও একসময় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন।
আর তাঁর দুই চাচা জন ব্রেসওয়েল এওবং ব্রেন্ডন ব্রেসওয়েল-দুজনই নিউজিল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলেছেন। বাবা চাচাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাইকেল ব্রেসওয়েলও সেই পথেই হেঁটেছেন।
ক্রিকেট পরিবারে জন্ম নেওয়া, এরপর সেখান থেকেই ক্রিকেটের সব দীক্ষায় হাতেখড়ি। তারপরও ব্রেসওয়েলের ক্রিকেটীয় আইডল একজন অজি ক্রিকেটার। তিনি অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। গিলক্রিস্টকে দেখেই বাঁহাতি ব্যাটার হওয়া, একই ভাবে উইকেট রক্ষক হওয়া। সেই ব্রেসওয়েলও তাঁর দুর্দান্ত এ ইনিংস দিয়ে ফিরিয়ে আনলেন গিলক্রিস্টের ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি। ব্যাটিংয়ের স্টাইল, শট সিলেকশন, হিটিং এবিলিটি- সব কিছুতে যেন গিলক্রিস্টের এক ছাপ পাওয়া গেল মাইকেল ব্রেসওয়েলের ব্যাটিংয়ে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এর আগে যদিও একটি সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। তারপরও ১৪০ রানের ইনিংস ব্রেসওয়েলের কাছে একটু বেশিই স্পেশাল। এই ইনিংসে কিউইরা জেতেনি ঠিকই, কিন্তু এই ইনিংসটা তাঁকে হঠাৎ করেই আলোচনায় এনেছে। এই ইনিংস খেলার পথে কোন বিষয়টি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে, কিভাবে খেললেন- এমন বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন এই এক ইনিংস খেলার কারণেই।
মাইকেল ব্রেসওয়েলও গণমাধ্যমের কাছে উত্তর দিয়ে সব কিছু খোলাসা করেছেন। মূলত ঘরোয়া ক্রিকেটই তাঁকে মানসিক ভাবে দৃঢ় করেছে, এমনটাই মনে করেন মাইকেল ব্রেসওয়েল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একজন ক্রিকেটারকে তৈরি হয়েই আসতে হয়। আমিও ঠিক সেভাবেই এসেছি। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রচুর ম্যাচ খেলেছি। আর এই অভিজ্ঞতায় বেশি কাজে দিয়েছে।’
কিউইদের ইনিংসের ২৯ তম ওভারে ব্যাটিংয়ে এসেছিলেন মাইকেল ব্রেসওয়েল। উইকেটে তখন কী মনে করে এসেছিলেন প্যাভিলিয়ন থেকে, আসলেই কি ম্যাচ জেতার দিকে চোখ ছিল তাঁর? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি যে কোনো অবস্থাতেই ম্যাচ জেতার চেষ্টা করা উচিৎ। আমি যখন উইকেটে গিয়েছি তখন আমরা চাপে ছিলাম। আমি শুধু সেটা কাটিয়ে উঠে ইনিংসটা এগিয়ে নিতে চেয়েছি। প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলতে আপনাকে চড়াও হতে ঠিক সময়ে। আমিও সেটিই করেছি।’
আইসিসির নতুন এফটিপিতে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। মাইকেল ব্রেসওয়েল মনে করেন, টি-টোয়েন্টির এই আবহ ওয়ানডে ক্রিকেটকে আরো গতিশীল করবে। ব্রেসওয়েলের এই ভাবনা এক দিক দিয়ে অনেকাংশেই ঠিক। আগের চেয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটের চিত্র এখন বেশ পাল্টে গিয়েছে। তিনশো, সাড়ে তিনশো রান এখন হরহামেশাতেই হয়। আর হাইস্কোরিং এসব ম্যাচগুলো বেশিরভাগ সময়েই দর্শকদের কাছে উপভোগ্য হয়। দিনশেষে ক্রিকেটের বাজার তো দর্শকদের কেন্দ্র করেই।
ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলার দিনে বাবা মার্ক ব্রেসওয়েলের কথা টেনে আনতে ভুল করেননি মাইকেল ব্রেসওয়েল। ক্রিকেট নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলেন তাঁর বাবার সাথেই। এমনকি ক্রিকেট নিয়ে সবার আগে পরামর্শ নেওয়ার জন্য ছুটে যান বাবা মার্কের কাছেই।
এক বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে কোচিং স্টাফ থেকে বেশ ভাল সমর্থনই পেয়েছেন মাইকেল ব্রেসওয়েল। ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত এ ইনিংস খেলার দিনে সেই কোচিং স্টাফদের কৃতিত্ব দিতেও ভুলে যাননি। স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত সফলই বলা চলে ব্রেসওয়েলকে।
তবে ক্যারিয়ার সমৃদ্ধির পথে তাঁর এখনও তা বহু পথচলা বাকি। সে পথচলা কতটা মসৃণ হবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে এখন পর্যন্ত নিজে যেভাবে সম্ভাবনার গল্প লিখেছেন তাতে সেই পথচলার সক্ষমতা তাঁর মাঝে আছে নিশ্চিতভাবেই। এখন সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়ণ করলে নিশ্চিতভাবেই দুর্দান্ত এক অলরাউন্ডার পেতে যাচ্ছে ব্ল্যাক ক্যাপসরা।