ফ্রান্সের হিরো, ফুটবলের ভিলেন

জীবন একটা  সিনেমা, এই সিনেমায় আমরা প্রতি নিয়ত ভিলেন থেকে হিরো হই আবার উল্টো দিকটারও দেখা মেলে। জীবন পরিক্রমায় হিরো থেকে ভিলেন বনে যাওয়া একটি চরিত্র মিশেল প্লাতিনি, হ্যাঁ! ফ্রান্স ফুটবলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মিশেল প্লাতিনি।

ফুটবল ক্লাবের মেডিকেল ট্রায়ালে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া থেকে ফুটবলের কিংবদন্তি হওয়ার গল্পটা দারুন রোমাঞ্চকর। আবার কিংবদন্তি থেকে দূর্নীতির দায়ে সেই ফুটবল থেকেই বিতারিত হওয়া হতাশার, চরম হতাশার! মিশেল প্লাতিনি তাঁর জীবনে এসব কিছুই দেখেছেন।

বাবা আলডোর হাত ধরে প্লাতিনির ফুটবল যাত্রার গোড়াপত্তন। ফ্রান্সের ক্লাব ন্যান্সির পরিচালক বাবা কিশোর প্লাতিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন সেরা খেলোয়াড় আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর খেলা দেখাতে। কিশোর প্লাতিনিকে ফুটবলের প্রেমে ফেলেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ সুপারস্টার আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। সেই থেকে প্লাতিনি আর ফুটবলের প্রেমের সম্পর্কের শুরু।

বড় আশা-ভরসা নিয়ে কিশোর বয়সেই গিয়েছিলেন ফ্রেঞ্চ ক্লাব মেটজেতে নিজেকে যাচাই করতে। কিন্তু ফুসফুসের পরীক্ষা চলাকালীন অবস্থায় জ্ঞান হারালে পেশাদার ফুটবলে খেলার আশা ম্লান হতে থাকে। কিন্তু ফুটবল সংগঠক বাবা কি করে তা হতে দেন?

ছেলেকে নিজে পথ দেখিয়ে দিতে শুরু করেন প্লাতিনির বাবা আলডো। তারপর সঠিক পরিচর্যা আর দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে প্লাতিনি খেলতে থাকেন বাবার অধীনস্ত ক্লাব ন্যান্সিতে। ১৯৭৩ এ অভিষেক হাওয়া প্লাতিনি ১৯৭৪/৭৫ মৌসুমে সতেরো গোল করে নিজের দল ন্যান্সিকে ফরাসি লিগ ২ থেকে লিগ ১ এ নিয়ে আসে। ম্লান হওয়া স্বপ্নের নতুন পাখায় ভর করে আকাশের নীলে উড়ে বেড়ানোর সূচনা হয় প্লাতিনির।

পরিশ্রম, শৈলী আর ভাগ্য এই তিনের সংমিশ্রণেই একজন খেলোয়াড় সেরাদের তালিকায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন। প্লাতিনি ছিলেন যথেষ্ট পরিশ্রমী এবং মধ্যমাঠের এই খেলোয়াড়ের ফুটবল শৈলীও ছিল নজড়কারা। অদ্ভুত রকমভাবে ভাগ্যও তাঁর সহায় হয়েছিল।

তাঁর সময়ে ফরাসি ফুটবলের এক নব-উত্থানের শুরু। ফরাসি ক্লাব সেইন্ট এতিয়েন ও বাস্তিয়া যথাক্রমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ইউরোপা লিগের ফাইনালে উঠে রীতিমত শোরগোল ফেলে দিয়েছিল পুরো ইউরোপে। সে সময়ে আবার উল্টো চিত্রও ঘটে। ১৯৭৮ এর বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে ফ্রান্স বিদায় নেয়। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দু’টো দিক দেখা প্লাতিনি ১৯৮২ তে ফান্স ছেড়ে পাড়ি জমান ইতালিতে।

মধ্য মাঠের নানন্দিক ফুটবলার প্লাতিনি ক্লাব ফুটবলে সর্বমোট ৩১২ গোল করেছেন তিনটি ক্লাবের হয়ে। আর ফ্রান্সের জাতীয় দলের জার্সিতে ৭২ ম্যাচে ৪১ গোল। নিজের ক্যারিয়ারে সেরা অর্জন হিসেবে প্লাতিনি নি:সন্দেহে ১৯৮৪ সালে ইউরো কাপ জেতার কথা বারে বারে সামনে নিয়ে আসবেন।

সেবার তাঁর অনবদ্য পারফরমেন্সেই তো জিতেছিল ফ্রান্স। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দমনীয় প্লাতিনি। পাঁচ ম্যাচে দুই হ্যাট্রিক মিলিয়ে করেছিলেন নয় গোল। যা ইউরো কাপের ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড। তিনি ছিলেন একজন  ১০ নাম্বার  খেলোয়াড়ের উৎকর্ষ উদাহরণ। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত খেলার ধরণ, অকল্পনীয় মানসিক উদ্যম আর দলকে উজ্জিবীত করার গুনাবলীই ছিল সেবার ফ্রান্সের শিরোপা জয়ের মুল টোটকা।

তবে আফসোসের বিষয় খেলোয়াড় হিসেবে তিন বার ব্যালন ডি’অর জেতা মিশেল প্লাতিনি ফুটবল সংগঠক হিসেবে ছিলেন বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁর খেলা যতটা না প্রশংসনীয় ছিল তাঁর সাংগঠনিক কার্যকলাপ ছিল ঠিক ততটাই নিন্দনীয়। খেলোয়াড় থেকে কোচ এবং পরে সেখান থেকে সংগঠক হিসেবে উয়েফার প্রেসিডেন্ট বনে যান প্লাতিনি। ২০০৭ সালে লেনার্ট জোহানসন কে হারিয়ে প্লাতিনি প্রেসিডেন্ট হন। জোহানসন টানা ষোল বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

কিন্তু উক্ত নির্বাচন বেশ ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছিল ইউরোপীয় ফুটবল অঙ্গনে। তার কারণ হিসেবে তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারের সাথে প্লাতিনির ঘনিষ্ঠতা অন্যতম। কেননা ব্লাটারের বিরুদ্ধে ফিফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দূর্নীতির অভিযোগ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি ও টাকার বিনিময়ে ভোট ক্রয় করার মত অভিযোগ পুরো ফুটবল দুনিয়ায়।

প্লাতিনি এবং তাঁর চিন্তাধারা নিয়ে বেশ সন্দিহান ছিলেন সমসাময়িক ফুটবল বোদ্ধারা। তাদের কেউ কেউ এমন মতও দিয়েছিলেন যে, প্লাতিনি উইয়েফার প্রেসিডেন্ট হলে তিনি ইউরোপীয় ফুটবলকে  ধ্বংস কর দেবেন। ফুটবলের জন্য তিনি ততটাও ভয়ংকর ছিলেন না। বরং ফুটবলের সার্বিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে তিনি ক্লাবগুলোতে স্থানীয় বা দেশীয় খেলোয়াড়দেরকে প্রাধান্য দিতে উৎসাহিত করতে এবং এ নিয়ে একটি নিয়ম তৈরির পক্ষে ছিলেন।

এমনকি তিনি ফুটবলে বর্তমানে বহু বিতর্ক সৃষ্টিকারী ভিডিও এসিসটেন্ট রেফারির বিপক্ষেও অবস্থান নিয়েছিলেন ফ্রেঞ্চ তারকা মিশেল প্লাতিনি। তাঁর স্বপক্ষে তিনি যুক্তি দেন এই ভিডিও এসিসটেন্ট রেফারি খেলার স্বাভাবিক গতি রোধ করবে। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন ভিএআর সংযুক্তির বিরুদ্ধে।

কিন্তু ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনে কাতারকে সমর্থন দেওয়ায়, প্লাতিনির দিকে সন্দেহের তীর পূর্ণ গতিতে ছুটতে শুরু করে। দূর্নীতির দায় আসতে থাকে তাঁর বিরুদ্ধে। এমনকি প্লাতিনির বন্ধু ফিফা প্রেসিডেন্ট ব্লাটারও তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায়।শেষমেশ কাতার বিশ্বকাপের ভেন্যু হওয়ায় প্লাতিনির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আরও তীব্র হতে থাকে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এর তদন্তের সম্মুখীন হতে এবং গ্রেফতারও হতে হয় প্লাতিনিকে। কিংবদন্তি এই খেলোয়াড়কে এক প্রকার বিতারিত করে দেওয়া হয় ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা উইয়েফা থেকে। পরবর্তীতে তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ফুটবলের সর্বস্তর থেকে।

ফুটবলের কিংবদন্তি কি না নিষিদ্ধ ফুটবলে। কি নির্মম! কি পরিমাণ লজ্জার। প্লাতিনির মত মধ্যমাঠ কাঁপানো একজন খেলোয়াড় যিনি কি না ছিলেন ফ্রান্স ফুটবলের উত্থানের নেপথ্যের হিরো, জীবনের শেষ বেলায় ভিলেন বনে গেলেন তিনি। এটাই প্রমাণ করে জীবনের পথচলা মসৃণ নয়। কন্টকাকীর্ণ এই পথে পা বাড়াতে হয় সাবধানে, হিসাব-নিকাশ করে। একটি ভুল পদক্ষেপ নিয়ে আসবে উন্নতির শিখর থেকে একেবারে সমুদ্রের গভীর অতলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link