‘দায়িত্ববান’ আফ্রিদির বিশ্বকাপ

আফ্রিদি নাকি দায়িত্ব নিয়ে খেলতে জানেন না - পুরো ক্যারিয়ারের এই অপবাদ এক নিমিষেই উড়িয়ে দিলেন আফ্রিদি। সেবার পুরো আসরজুড়েই অবশ্য চলেছে আফ্রিদির ‘ওয়ান ম্যান শো’। সাত ম্যাচে দু’টি হাফ সেঞ্চুরি-সহ ১৪০.৮০ স্ট্রাইক রেটে করেন ১৭৬ রান, এর বাদে বল হাতে নেন ১১ উইকেট। 

একটা বিশ্বকাপ, একটা স্বপ্নভঙ্গের গল্প। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের ক্লাছে ফাইনালে ধরাশায়ী হবার পর প্রথম আসরেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা হাতছাড়া হয় পাকিস্তানের। এরপর কেটে গেছে প্রায় দুই বছর। ফাইনাল হারের আক্ষেপটা ঠিক পোড়াচ্ছিল মিসবাহ-আফ্রিদিদের। সেখান থেকেই নতুন এক স্বপ্ন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর, নতুন এক চ্যালেঞ্জ। রচিত হলো নতুন এক গল্পের, নতুন এক ইতিহাসের; পাকিস্তানের শিরোপা জয়ের এক মহাকব্যিক অধ্যায়ের।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে মাত্র পাঁচ রানে হেরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী আসরে শিরোপা জিততে পারেনি পাকিস্তান। সেদিন মিসবাহ উল হকের আপ্রাণ চেষ্টার পরেও শেষ ওভারে ম্যাচ জিততে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান।

ব্যবধানটা দুই বছরের। সেদিনের হতাশা আর ব্যর্থতার গ্লানি মুছে ফেলে দুই বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টির বিশ্ব আসরে শিরোপা জয়ের অধরা স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ দেয় পাকিস্তান। ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ৮ উইকেটের ব্যবধানে হারিয়ে ইউনুস খানের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় পাকিস্তান। আব্দুল রাজ্জাকের বিধ্বংসী বোলিং আর শহীদ আফ্রিদির অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের দিনে ভাটা পড়ে কুমার সাঙ্গাকারার একা হাতে লড়াই করা দুর্দান্ত সেই ইনিংস।

২১ জুন, ২০০৯।

লর্ডসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। আগের আসরে ২০০৭ সালে ভারতের কাছে ৫ রানের পরাজয়ের আক্ষেপটা ঘুচিয়ে আরেকবার শিরোপা জয়ের স্বপ্নে তখন বিভোর পাকিস্তান। অপরদিকে, প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টির বিশ্বআসরে ফাইনালে উঠে শিরোপা জয়ে নজর লঙ্কানদের।

টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন লঙ্কান অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা। ব্যাট করতে নেমে মোহাম্মদ আমির ও আব্দুল রাজ্জাকের আঘাতে শুরু থেকেই উইকেট হারাতে থাকে লঙ্কানরা। প্রথম ওভারেই আমিরের শিকার বনে গিয়ে শূন্য রানেই আউট হন তিলকারত্নে দিলশান। পরের ওভারে শূন্য রানেই আউট জিহান মোহাবরকও। মাত্র ২ রানে তুলতেই ২ উইকেট নেই লঙ্কানদের। পাকিস্তানি পেসারদের দাপটে বিপাকে লঙ্কান শিবির। এরপর সনাথ জয়সুরিয়ার ১০ বলে ১৭ রানের ইনিংসে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত। কিন্তু, নিজের দ্বিতীয় ওভারেই জয়সুরিয়াকে ফিরিয়ে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন রাজ্জাক।

ইনিংসের ষষ্ঠ আর নিজের তৃতীয় ওভারে বল করতে এসে মাহেলা জয়বর্ধনেকে তুলে নিয়ে লঙ্কানদের ব্যাকফুটে ঠেলে দেন রাজ্জাক। মাত্র ৩২ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে কোণঠাসা লঙ্কানরা। একপ্রান্তে অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা দাঁড়িয়ে তখন সতীর্থদের যাওয়া-আসার মিছিল দেখছেন। ৩ ওভারের স্পেলে মাত্র ২০ রান দিয়ে ৩ উইকেট শিকার করেন রাজ্জাক। অবশ্য দুর্দান্ত এক স্পেলের পরেও সেদিন নিজের কোটা পূর্ণ করতে পারেননি এই অলরাউন্ডার।

বিপর্যয়ের  মুখে তখন চামারা সিলভাকে নিয়ে ভীত গড়ার চেষ্টায় মত্ত সাঙ্গাকারা। টি-টোয়েন্টি হলেও টপাটপ উইকেট হারিয়ে ইনিংসের দশম ওভারে গিয়ে দলীয় রান তখন মাত্র পঞ্চাশের কোটায়। লর্ডসে সেদিন পাকিস্তানি বোলারদের সামনে লঙ্কানদের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখেছিল ক্রিকেট দুনিয়া। পঞ্চম উইকেটে ৩৬ বলে ধীরগতির ৩৫ রানে জুটির পথে চামারা সিলভাকে ১৪ রানে ফেরান উমর গুল। এরপর দলের সাথে তিন রান যোগ হতেই আউট ইসুরু উদানাও। মাত্র ৭০ রানেই দলের ৬ উইকেট নেই।

ফাইনালের মঞ্চ, লর্ডসে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল লঙ্কানদের ব্যাটিং শিবির। গ্যালারিতে লঙ্কান ফ্যানদের নিরব কান্না। একপ্রান্তে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সাঙ্গাকারাও যেনো এই ব্যর্থতার হিসেব মেলাতে পারছেন না। সপ্তম উইকেটে নামলেন তরুণ অলরাউন্ডার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। ১৫ ওভার শেষে দলের রান তখন ৬ উইকেটে মাত্র ৭৯। লঙ্কানদের জন্য যেন শুরু না হতেই ফাইনালের সমাপ্তি। লড়াইয়ের আগেই অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত উঁচিয়ে নিজেদের অসহায়ত্ব জানান দিয়েছিল লঙ্কা বাহিনী।

রান রেট তখন পাঁচের সামান্য একটু উপরে। টি-টোয়েন্টিতে ওয়ানডের আমেজ। ফাইনালের উৎসব কিংবা কোনো আমেজের রেশ মাত্র নেই। ম্যাচ তখন পুরোপুরি পাকিস্তানের দখলে। আফ্রিদি-আজমলদের দৃঢ় বোলিংয়ে দ্রুত রান তোলার সুযোগই পায়নি লঙ্কানরা।

এরপরই  লর্ডসের মাটিতে খানিকটা ঝড়ের দেখা। সাঙ্গাকারা ও ম্যাথুসের ব্যাটে যেন ম্যাচ প্রাণ ফিরে পেলো। শেষের ঝড়ে লড়াই করার মত দলকে পুঁজি এনে দিয়েছিলেন সাঙ্গাকারা, ম্যাথুসরা। কুমার সাঙ্গাকারার ৫২ বলে অপরাজিত ৬৪ আর ম্যাথুসের ২৪ বলে ৩৫ রানের ক্যামিওতে শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ২০ ওভারে ৬ উইকেটে ১৩৮ রানের ফাইটিং টোটাল সংগ্রহ করে লঙ্কানরা। শেষ পাঁচ ওভারে কোনো উইকেট না হারিয়ে ৫৯ রান যোগ করে সাঙ্গাকারা-ম্যাথুসরা। পাকিস্তানের পক্ষে ২০ রানে রাজ্জাক তিনটি ও একটি করে উইকেট নেন মোহাম্মদ আমির ও উমর গুল। সেবার গোটা আসর জুড়েই দারুণ ফর্মে ছিলেন উমর গুল। পুরো আসর জুড়ে শিকার করেন ১৩ টি উইকেট।

পাকিস্তানের সামনে তখন সহজ লক্ষ্যমাত্রা। শিরোপা জিততে প্রয়োজন খুবই স্বল্প রানের। কামরান আকমলের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ওপেনিং জুটিতেই আসে ৪৭ রান। ওপেনিং জুটিতেই জয়ের ভীত পায় পাকিস্তান। ২৮ বলে ৩৭ রানের ঝড়ো ইনিংসের পর কামরান বিদায় নিলেও পাকিস্তানের জয়ের পথটা সহজ করে দেন আকমল। দ্বিতীয় উইকেটে ব্যাট করতে আসেন শহীদ আফ্রিদি।

পাকিস্তানের অবস্থা তখন ৯.১ ওভারে ২ উইকেটে ৬৩ রান। শিরোপা জিততে তখনো প্রয়োজন ৬৫ বলে মাত্র ৭৬ রান, হাতে ৮ উইকেট। লঙ্কানদের মনে তখনো জয়ের বিন্দু আশা উঁকি দিলেও – সেটা ম্লান হয়ে যায় আফ্রিদির ঝড়ো ফিফটিতে। লঙ্কানদের স্বপ্নভঙ্গের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুঁকে দেন এই বিধ্বংসী তারকা।

তৃতীয় উইকেটে শোয়েব মালিকের সাথে ৫৭ বলে ৭৭ রানের জুটির পথে আফ্রিদি খেলেন ৪০ বলে ৫৪ রানের এক হার না মানা ইনিংস। ২ চার ও ২ ছয়ে নান্দনিক শটে দুর্দান্ত এক ইনিংস সাজান পাকিস্তানি এই অলরাউন্ডার। আরেকপ্রান্তে ২২ বলে ২৪ রানের ইনিংসে যোগ্য সমর্থন দেন শোয়েব মালিক।

আফ্রিদি নাকি দায়িত্ব নিয়ে খেলতে জানেন না – পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে গায়ে লেগে থাকা এই অপবাদ এক নিমিষেই উড়িয়ে দিলেন আফ্রিদি। সেবার পুরো আসরজুড়েই অবশ্য চলেছে আফ্রিদির ‘ওয়ান ম্যান শো’। সাত ম্যাচে দু’টি হাফ সেঞ্চুরি-সহ ১৪০.৮০ স্ট্রাইক রেটে করেন ১৭৬ রান, এর বাদে বল হাতে নেন ১১ উইকেট।

সেবার লঙ্কানদের হারিয়ে লর্ডসের মাটিতে এক ঐতিহাসিক জয় তুলে নেয় পাকিস্তান। আগের আসরেই ফাইনালে শেষ ওভারে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয়; সেই আক্ষেপ ঘুচিয়ে পরের আসরেই শিরোপা ঘরে তোলে পাকিস্তান।  শোয়েব মালিকের নেতৃত্বে ২০০৭ সালের ফাইনালে পরাজয়ের পর ইউনুস খানের নেতৃত্বে সেই অধরা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয় বিরানব্বইয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...