কতটা বেদনা নীরবে সয়েছি

‘যারা আমাকে স্যার বলে, লর্ড বলে তারা আমাকে এখানে নিয়ে আসে নাই। এখানে আসতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।’ কিছুদিন আগে ইএসপিএন ক্রিকইনফো’র একটি ইন্টারভিউতে কথা গুলো বলেছিলেন মোহাম্মদ মিঠুন। অনলাইনে ক্রমাগত ট্রলের শিকার হওয়া নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে এমন কথা বলেছিলেন তিনি।

মিথুনের জন্ম ১৯৯১ সালে। কুষ্টিয়ার ছেলে মিথুনের বেড়ে উঠা বিকেএসপি-তেই। আর সেখানে পড়াকালীন অবস্থায় মোহাম্মদ মিথুনের নাম ছড়িয়েছে ‘প্রডিজি’ হয়ে। এত বড় উপাধি জুড়ে গিয়েছিল নামের সাথে, আর নিজের সাথে জুড়েছিলো পাহাড়সম প্রত্যাশা। শুরুটা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে, আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে লম্বা ইনিংস খেলার সামর্থ্যের জন্য দেশব্যাপী নাম ছড়িয়েছিলো তাঁর।

মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক; তার কিছুদিন পর খেলেছিলেন মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপও। পারফরম্যান্স ঠিকঠাক করে গেলেও ধারাবাহিকতার একটা অভাব ছিল মিথুনের ব্যাটে। তাই হয়তো ২০০৬-০৭ থেকেই ঘরোয়াতে খেললেও জাতীয় দলে প্রথম ডাক পান ২০১৪ সালে। সুখকর হয়নি অভিষেক, দল থেকে বাদ পড়েছেন।

অভিষেকটা ২০১৪ সালে হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেটে তিনি লাইমলাইটে আসেন ২০১৮-তে। দীর্ঘ বিরতি কাটিয়ে দলে ফিরেন ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে। প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে খেলেন ৬৩ রানের মূল্যবান ইনিংস। একই টুর্নামেন্টে অলিখিত সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রায়ই একই পরিস্থিতিতে আবারো ৬০ রান করে দলকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করেন।

এরপরের নিউজিল্যান্ড সফরেই যখন দলের বাকি ব্যাটসম্যানদের যেখানে নাভিশ্বাস উঠেছিল সেখানে পরপর দুই ম্যাচে দুই ফিফটি মিথুনের। সবশেষ কিউই সফরেও যে ম্যাচে জয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল বাংলাদেশ সে ম্যাচেও দূর্দান্ত এক ৭৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। তবে এমন হাতেগোনা কয়েকটা ভাল ইনিংস দিয়েই তো একজন ব্যাটসম্যানকে কখনোই মানসম্মত বলা যায় না।

লিটন,সৌম্যদের মত অমিত প্রতিভা নিয়ে আসেননি মিথুন। বিধাতা প্রতিভার ভান্ডার থেকে যৎসামান্যই বরাদ্দ করেছিলেন তার জন্য। কেউ কেউ হয়তো ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে আসেনা, কিন্তু বিশ্বাস করুন এই প্রতিভা না থাকাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সক্ষমতা সবার থাকেনা। মিথুন জানিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ, হয়তো পেরে উঠতে পারেননি। নিজের ভুল তো আছেই, সাথে বিসিবির দূরদর্শিতার অভাবও দায় এড়াতে পারে না।

এক ফরম্যাটে ভাল খেললে বাকি ফরম্যাটে দ্রুতই দলে ডাকার মত ঘটনা মিঠুনের ক্যারিয়ারেও ঘটেছিলো। আর সেখানেই শুরু রাজ্যের ট্রল,মিম আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। টি-টোয়েন্টিতে পারেননি মানানসই ব্যাটিংটা করতে পারেননি। টেস্টেও মাটি কামড়ানো ব্যাটিং আয়ত্তে নেই তার। খুবই সাদামাটা একজন ওয়ানডের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এই টানাপোড়েনে টিকতে পারেননি,ঘটেছে ছন্দপতন।

ঘরোয়া ক্রিকেটেও বরাবরই পারফর্ম করেন মিঠুন। আহামরি নয়, তবে অন্য অনেকের চেয়ে ভাল করেন এই ব্যাটসম্যান। কিন্তু ট্রলের শিকার হওয়াতে তিনি সবার আগেই। তার নামে একটা পেজ খুলে ট্রল করা যতটা সহজ, ততটা বোধহয় বাইশ গজে ব্যাট ধরা সহজ নয়। একজন খারাপ খেললে তার সমালোচনা হয়, এটি বিরাট কোহলি কিংবা স্টিভ স্মিথ এর জন্যও সত্য। কিন্তু বুলিং আর সমালোচনা যে এক নয় তা বুঝতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের এখনো ঢ়ের বাকি।

মিঠুনের ওয়ানডেতে ব্যাটিংগড় ২৭ এর একটু বেশি,টেস্টে সেটা ১৮ আর টি-টোয়েন্টিতে ১০! কিন্তু মজার ব্যাপার তার পারফরম্যান্সের সাথে ব্যঙ্গবিদ্রুপের সম্পর্ক খুব কমই। কিছুদিন আগে মিঠুনের ডাবল সেঞ্চুরি করার খবরেও দাঁত বের করে হাসি দিয়ে আর হাহা প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আমরা যেন আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধিকেই ব্যঙ্গ করেছি।

মিঠুনরা ক্রিকেটে উঠে আসতে আসতে সৃষ্টি করেছেন গল্প। এদের কারো গল্প হয়তো আমরা মুখস্থ করে সকাল বিকাল আওড়ে যাই। আর কারো গল্প জানার কথা আমাদের মনেও আসে না। আপনি-আমি এই উঠে আসার গল্পগুলো না জানলেও কাছের মানুষেরা ঠিকই জানে, ক্রিকেটটা যারা খেলে তাঁরা ঠিকই জানে। আর তাই ইসুরু উদানা টুইট করেন, আমাদের থামতে বলেন। মনে করিয়ে দেন পুরো গল্প না জেনে কাউকে বিচার করা ঠিক না। কিন্তু আমরা থামিনা, বুনো উল্লাসে দাঁত বের করে হাসাহাসির নামে নোংরামি করি।

এই লেখনী কখনোই মিঠুনদের বিপক্ষে করা অনাকাঙ্ক্ষিত ‘সাইবার বুলিং’ থামাতে পারবে না। আমার এই লেখাটার পর এর মাত্রা কমবে এমনটা আশাও করি না। মিঠুনের পক্ষে সাফাই গাওয়াও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। ক্রিকেটের পরিসংখ্যানে মিথুনের অবস্থান মোটেই উঁচুতে নয়। কিন্তু কতটা নিচুতে সেটা জানেন? সেটা জানা থাকলে উপহাস করতে সুবিধা হয়না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link