ব্রাজিলিয়ানদের কাছে মারাকানাজো শব্দটা একটা দু:স্বপ্ন।
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে এই মাঠেই সেলেকাও রা উরুগুয়ের কাছে হেরে গিয়েছিলো ২-১ গোলে। এই হারের কথা ব্রাজিলিয়ান রা কখনো ভুলতে পারেনি, বরং হয়েছে জাতীয় শোকের একটা ব্যাপার। ব্রাজিলিয়ান লেখক নেলসন রদ্রিগুয়েজ এর ভাষায় ‘আমাদের জাতীয় বিপর্যয়, আমাদের হিরোশিমা।’
ফাইনালের এই ঘটনায় ব্রাজিল দলের খেলোয়াড়দের মাঝে সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন যে খেলোয়াড়, তাঁর নাম বারবোসা, দলের গোলকিপার। মাত্রই তৈরী হওয়া মারাকানা স্টেডিয়াম তখন ছিলো পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ফুটবল স্টেডিয়াম-দরিদ্র একটি দেশ এক স্টেডিয়ামের পেছনে এতো অর্থ খরচ করার একটাই কারন-ব্রাজিল নামের দেশটার জাতীয় লক্ষ্য পুরো পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা। ফুটবল।
প্রায় ২ লাখ দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এই স্টেডিয়ামেই দুই লাখ মানুষের চার লাখ চোখের সামনে লজ্জায় ডুবতে হয়েছিলো ব্রাজিল দলকে। তাও নিজের দেশের মাটিতে।
ঐ সময় বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টের ছিল এক বিচিত্র ফরম্যাট । শেষ চার দলের গ্রুপ স্টেইজে সুইডেন কে ৭-১ এবং স্পেইন কে ৬-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ব্রাজিল দলের দরকার ছিলো মাত্র একটা ড্র । রিও’র দৈনিক খবরের কাগজ ‘ও মুন্দো’ একেবারে খবরের কাগজেই ঘোষণা করে দিয়েছিলো ব্রাজিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, তাও খেলার আগে। টুর্নামেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ‘জুলে রিমে’ পর্তুগিজ ভাষায় ব্রাজিল দলের জন্যে অভিনন্দন বক্তৃতাও লিখে রেখেছেন আগেভাগেই। দলের সবাইকে চেঞ্জিং রুমে একটা করে সোনার ঘড়িও উপহার দেয়া শেষ। মজার বিষয় হচ্ছে খেলা তখনও শুরুই হয়নি।
ব্রাজিল যে বিষয়টি মাথায় তখন রাখেনি, তা হচ্ছে উরুগুয়ে দেশটার জন্মই হচ্ছে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার বেশ লম্বা যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে। এদের রক্তে আছে দ্রোহের আগুন, অনমনীয় মনোভাব, লাতিন ভাষায় ‘গাররা চারুরা’। উরুগুইয়ান রা তাদের দেশের জন্মলগ্ন থেকেই জাতি হিসেবে সমস্ত বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে চলা জাতি। অপমানের জবাব তারা দেবেই, শরীরে রক্তের শেষবিন্দু পর্যন্ত লড়ে যাওয়া এদের অভ্যাস।
উরুগুয়ের ঐ সময়ের দলনেতা, কাপ্তান ‘ওবদোলিও ভ্যারেলা’ ব্রাজিলিয়ান পত্রিকা ‘ও মুন্দো’র হেডলাইনে এতোই চটে গিয়েছিলেন যে পত্রিকার যতো কপি হাতের কাছে পেয়েছিলেন সব কিনে এনে ড্রেসিং রুমের মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে গোটা দল তার উপর প্রস্রাব করেছিলেন।
ফাইনালের প্রথমার্ধ গোলশূন্য হিসেবে শেষ হবার পর, দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ব্রাজিলের ফ্রিয়াকা গোল দিয়ে দিলেন ৪৭ মিনিটের মাথায়।
উরুগুয়েও খেলায় ফিরলো কিছুক্ষন পরই। ‘অ্যালসাইডস ঘিঘিয়া’ রাইট উইং ধরে বল নিয়ে ছুটে সোজা ঢুকে গেলেন ব্রাজিলের বক্সের প্রান্তে, ওখান থেকে একটা ক্রস, বল খুঁজে পেলো উরুগুয়ের ‘শিয়াফিনো’কে। শিয়াফিনোর ব্রাজিল কিপারকে ফাঁকি দিয়ে গোল দিতে কোন সমস্যাই হয়নি। খেলায় তখন ৬৬ মিনিট চলছে। এর ঠিক ১৩ মিনিট পর ঠিক একই জায়গায় আবারো সেই ঘিঘিয়া বল পেলেন, ঢুকে গেলেন বক্সে।
ওদিকে গোলপোস্টের নিচে ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক ‘বারবোসা’, চেপে গেলেন নিজের একটু ডান দিকে, আশা করছিলেন এবারেও ঘিঘিয়া বল ক্রস করবেন। বারবোসার জীবনে এই একটু ডানে চেপে যাওয়াটাই ছিলো সবচেয়ে বড় ভুল। ঘিঘিয়া কোন ক্রসের ধারকাছে না গিয়ে নিজেই বারের কাছ ঘেঁষে নিচু করে নিলেন এক জোড়ালো শট। বারবোসার সর্বোচ্চ চেষ্টাকেও ফাঁকি দিয়ে বল জড়ালো জালে।
এই ঘটনার দীর্ঘদিন পর ঘিঘিয়া বলেছিলেন, ‘এক লহমায় মারাকানাকে একদম চুপ করিয়ে দিতে পারে এই পৃথিবীর মাত্র তিনজন, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, পোপ জন পল আর আমি।’
দূর্ভাগ্যজনক ভাবে, এই ম্যাচ শেষে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিলো ব্রাজিল দলের কৃষ্ণাঙ্গ তিন খেলোয়াড়কেঃ সেন্টার-হাফ বাইগোড, লেফট ব্যাক জুভেনাল এবং কিপার বারবোসা- এই মানুষগুলোকে ১৯৫০ এর এই দুঃসহ স্মৃতি সারাটা জীবনের কোন সময়ই ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ ব্রাজিলিয়ানরা দেয়নি। খুব ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এই টুর্নামেন্টে সাংবাদিক দের ভোটে সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘বারবোসা’।
এই খেলার পর মাত্র একটা ম্যাচে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন বারবোসা। ১৯৯৩ সালে মানুষটা ব্রাজিল জাতীয় দলের একটা ট্রেনিং ক্যাম্পে ঢুকতে চেয়েছিলেন। তাঁকে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। কারন ও সময়ের ব্রাজিল ফুটবল কতৃপক্ষ মনে করেছিলেন দলের জন্যে দূর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে যাবেন বারবোসা। এই ঘটনায় বারবোসা মানুষ হিসেবে একেবারে ভেঙ্গে পরেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষটার একটাই কথা ছিলো, ‘আমি কোন পাপ করিনি, আমি দোষীও নই। খেলাটা আমি একা খেলিনি, দলেতো আরো ১০ জন ছিল।’
ভাগ্যের পরিহাস হচ্ছে, ভাস্কো দ্য গামা ক্লাবে ক্লাব ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ করে বারবোসা সেই মারাকানা স্টেডিয়ামেই চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। ১৯৬৩ সালের কথা। বারবোসা বার্বিকিউ পার্টিতে বেশ কয়জন বন্ধুকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। বার্বিকিউ তে দেখা গেলো ধোঁয়া খুব ভারি এবং উৎকট গন্ধের, বন্ধুরা খেয়াল করে দেখলেন বার্বিকিউর আগুন কয়লার বদলে জ্বলছে অদ্ভুত সাদা মোটা সব কাঠ। মারাকানার সেই গোলবার। বারবোসা এই গোলবার জ্বালিয়ে দিয়ে জীবনে আসা দূর্ভাগ্যের কালো ছায়া দূর করার চেষ্টা করছেন।
বারবোসা সেই বার্বিকিউ খেয়ে বলেছিলেন, জীবনের সেরা বার্বিকিউ খেলেন। গোল বার জ্বালিয়ে দেবার পরেও দূর্ভাগ্য বারবোসার পিছু ছাড়েনি। ১৯৭০ এ ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতে পেলের হাত ধরে। সেই পেলে ১৯৫০ এর ঘটনা মনে করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘১৯৫০ আমি ছিলাম ছোট, খালি কেঁদেছি, খালি কেঁদেছি ফাইনালের পর।’
শুধু পেলে না, বাজিলের সাধারণ জনতার অভিশাপ ও বারবোসা সারা জীবন পেয়ে গেছেন।
সেই ১৯৫০ এরই একটা ঘটনা শোনা গেছে। বাজারে এক স্থানীয় নারী বারবোসার দিকে আঙুল তুলে তার বাচ্চাকে দেখিয়ে বলছেন, ‘দেখো বাবা, এই লোকটার জন্য সারা ব্রাজিল কাইন্দা ভাসাইছিল।’
২০০০ সালের এপ্রিলে, নি:স্ব অবস্থায় মৃত্যুর সময় বারবোসা তীব্র আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলের আইনানুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হচ্ছে ৩০ বছর। কিন্তু আমার এই দণ্ডটা পেয়ে যেতে হলো ৫০ বছর।’
এরকম অভিশপ্ত আরেক খেলোয়াড় হচ্ছেন ইতালির রবার্তো ব্যাজ্জিও। ১৯৯৪ এর ফাইনালে ট্রাইবেকারের একটা শট মিসে কাপটা এই ব্রাজিলের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। একটা মিসে ইতালিরও কেউই মনে রাখেনি যে ঐ বিশ্বকাপে ইতালি ফাইনালে গিয়েছিলোও ব্যাজিওর কারণেই। এরপরের জীবনটা এই ‘ডিভাইন পনিটেইল ফুটবলারের কাটছে তীব্র বিষাদ নিয়ে।
যেসব দেশ, জাতি খেলাপাগল, তারা কোন এক অজ্ঞাত কারনে নিজেদের পরাজয় কখনো মেনে নিতে পারেনা। কাউকে না কাউকে বলির পাঁঠা হতেই হয়। এই হিসেবে মানুষ মাথায় রাখা হিরোকে মাটিতে আছড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেনা। আশ্চর্য্য এক প্রাণী আমরা!