আমাদের নিজস্ব পরশ পাথর

কোচ হিসেবে অনুশীলনে নিজ দলের খেলোয়াড়দের শলা-পরামর্শ দিচ্ছেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিপক্ষের ক্রিকেটাররাও নিজেদের প্রয়োজন ছুঁটে আসছেন তাঁর কাছে। তিনিও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। ভুল শুধরে দিচ্ছেন। প্রতিপক্ষের হলেও নিজ দেশের ক্রিকেটার। আর তাঁদের উন্নয়নে তিনি পরামর্শ দিতে কখনোই কার্পণ্য করেন না।

সাকিব, তামিম, মুমিনুলসহ অনেক ক্রিকেটারের শেষ ভরসা। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) কিংবা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) সবচেয়ে সফল কোচ তিনি। টানা ব্যর্থতা কিংবা ভুল শোধরাতে ক্রিকেটাররা ছুঁটে যান তার কাছে। তিনিও কখনোই ক্লান্ত হননি। দুহাত ভরে দিয়েছেন বহু ক্রিকেটারদের। তাঁর হাত ধরেই জাতীয় দলে উঠে এসে ক্যারিয়ার গড়েছেন অনেক ক্রিকেটার।

হ্যাঁ, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল একজন কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। পুরনো শিষ্যদের ভুল শুধরে দেন সবসময়ই। ২০১৯ সালে সাকিবের মহাকাব্যিক বিশ্বকাপে সালাউদ্দিনের অবদানের কথা তো কারও অজানা নয়।

বহু বছর আগের কথা। সাকিবের বয়স তখন ১৫ কি ১৬। সেসময় বিকেএসপিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করবে আশরাফুল ও সাকিব।’ অবশ্য আশরাফুল তখন ছিলেন জাতীয় দলের সেরা এক তারকা। সাকিবও ধীরে ধীরে উঠছিলেন। এরপর গল্পের বাকিটা সবারই জানা।

নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার বলতে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলা। সেখান থেকেই বিকেএসপিতে খণ্ডকালীন কোচ হিসেবে চাকরি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সালাউদ্দিনকে। এখন তিনি বাংলার ক্রিকেটে বেশ পরিচিত এক মুখ। প্রয়োজন হলেই সাকিব-তামিমরা ছুঁটে যান তাঁর কাছে।

সালাউদ্দিন অবশ্য বিকেএসপিতে গিয়েছিলেন ফুটবলে ভর্তি হতে। তবে ফুটবলে তিনি সুযোগ পাননি। নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্রিকেটে। ফুটবলের প্রতি ঝোঁকটা ছেলেবেলা থেকেই ছিল। অবশ্য একসময় ক্রিকেটের চেয়েও বাংলাদেশের ফুটবলের উন্মাদনা ছিল অনেক বেশি। তবে পছন্দের খেলায় যেতে পারেননি সালাউদ্দিন। ফুটবলের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ সালাউদ্দিন পাশ করলেন ক্রিকেটের পরীক্ষায়।

হতাশ ছিলেন। ক্রিকেটকে শুরুতে আপন করে নিতে চাননি। কিন্তু এই ক্রিকেটই পরবর্তীতে তাঁকে নিয়ে গেল সফলতার শীর্ষে। বনে গেলেন দেশসেরা ক্রিকেট কোচ!

বিকেএসপিতে চাকরি পান। শুরুতে খণ্ডকালীন, পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে স্থায়ী হন তিনি। ২০০২ সালে ডিপিএলে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে পেশাদার কোচিংয়ে পদযাত্রা। দলের মূল কোচ হঠাৎ মারা যাওয়ায় সেই দায়িত্বটা পেয়ে যান সালাউদ্দিন। ওই মৌসুমে তাঁর অধীনে ডিপিএলের শিরোপা জিতে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। পরের মৌসুমে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের হয়ে আবারও শিরোপা জেতান তিনি!

ততদিনে ঘরোয়া ক্রিকেটের বেশ সফল একজন কোচ তিনি। সফলতার রেশটা ঘরোয়া ক্রিকেটে গণ্ডি পেরিয়ে তাকে টেনে আনলো বাংলাদেশ জাতীয় দলে! সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেলেন। জেমি সিডন্স, ডেভ হোয়াটমোরদের সাথে যুক্ত হয়ে শিখিয়েছেন মাশরাফি মুর্তজা, হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ আশরাফুলদের। এরপর ফিল্ডিং কোচ হিসেবেও কিছু সময় দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

ওই সময় অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের জন্য নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু সালাউদ্দিন চার মাসের মধ্যেই রাজ্জাকের অ্যাকশন শুধরে বাঁচিয়ে দেন সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার। সেই সাথে সালাউদ্দিনের টোটকা কাজে লাগিয়ে স্পিনে বাংলাদেশের অন্যতম ভরসা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন রাজ্জাক।

২০০৯ সালের নভেম্বরে কিন্তু হঠাৎ করেই কারণ ছাড়াই বরখাস্ত হন সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিনের সাথে চুক্তিও নবায়ন করেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।

তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচ হিসেবে ছিলেন নিয়মিত মুখ। ২০১৫-২০১৬ মৌসুমে বিপিএলে দায়িত্ব নেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের। কাগজে-কলমে শক্তিমত্তার দিক থেকে সেবার অনেকটাই পিছিয়ে ছিল কুমিল্লা। তবে সালাউদ্দিনের জাদুর পরশে সেবার শিরোপা ঘুরে তুলেছিল কুমিল্লা। পরের বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০১৬ -২০১৭ মৌসুমে ডিপিএলে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের দায়িত্ব পেয়ে দলকে এনে দিয়েছিলেন শিরোপা।

জাতীয় দল ও ঘরোয়া লিগ ছাড়াও কাজ করেছেন মালোয়শিয়ায়। সেখানে ঘরোয়া লিগে এক দলের হয়ে কোচিং করান তিনি। সেখান থেকে আবার যোগ দেন বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। ২০১৫ সালের পর ২০১৯ বিপিএলেও তাঁর অধীনে শিরোপা জেতে কুমিল্লা। সালাউদ্দিনের কাছে হয়ত কোনো জাদুর কোটা আছে। নাহলে তিনি যেখানেই পা রাখেন সেখানেই সফলতার দেখা পান কি করে? হয়ত কোনো পরশ পাথর আছে। যে পাথরের ছোঁয়ায় তিনি বদলে দেন ক্রিকেটারদের।

২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে আগে একবার কাজ করার জন্য সালাউদ্দিনকে ডাকা হয় বিসিবির পক্ষ থেকে। কিন্তু এরপরও উপেক্ষা করা হয় তাঁকে। এরপর ২০২১ সালে গেল বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর কোচিং প্যানেলে যুক্ত হতে বিসিবি থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় সালাউদ্দিনকে। কিন্তু পেশাদারিত্বের কারণ দেখিয়ে সেই দায়িত্ব নেননি এই কোচ। মূলত মাসকো সাকিব অ্যাকাডেমির প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্বে থাকায় বিসিবির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন সালাউদ্দিন।

তিনি বলেন, ‘সেখানে (মাসকো সাকিব অ্যাকাডেমি) অনেকেই আমার জন্য ভর্তি হয়েছে। আমার কাছে শিখতে যায়। তাদের ফেলে এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারব না।’

বছরের পর বছর উপেক্ষিত থাকার পর সুযোগ পেয়ে বিসিবির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও খেলোয়াড়দের উন্নয়নে সবসময়ই পাশে থাকছেন সালাউদ্দিন। সাকিব আল হাসান থেকে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাশরাফি মুর্তজা, নাসির হোসেন, মুমিনুল হক সবাইকেই শিখিয়েছেন তিনি। নিজেদের খারাপ সময়ে ক্রিকেটাররা সবার আগে স্মরণ করেন এই কোচকে।

তাঁর টোটকাতে ব্যর্থতার শিকল ছিঁড়ে সফল হয়েছেন অনেকেই। তবু কেন উপেক্ষা! অপমান! দেশসেরা এই সফল কোচ কি বিসিবির কাছ থেকে কখনো প্রাপ্য সম্মানটুক পেয়েছে? প্রশ্নটা তোলা রইল বাংলার ক্রিকেট সমর্থকদের কাছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link