ইনজুরির কারণে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপটা শেষ পর্যন্ত খেলতে পারেননি। তবে বন্ধুরা যখন বিশ্ব জয় করে দেশে ফিরলো তখন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ছুটে গিয়েছিলেন বিমানবন্দরে। উৎসুক জনতার সারিতে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের পদার্পন দেখছিলেন। পরে বন্ধুরা দূর থেকে দেখে তাঁকে ডেকে নিয়েছিল, বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। অথচ তিনিই ছিলেন দলটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিশ্বকাপে ঝড় তোলা হয়নি তবে সেই বারুদটা জমিয়ে রেখেছিলেন।
এবার বিপিএলে , বিশেষ করে ডেথ ওভারে যেন অপ্রতিরোধ্য এই পেসার। মাত্র ৪ ম্যাচ খেলেই তুলে নিয়েছেন ৮ উইকেট। খেলা ৭১-এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী জানালেন তাঁর বোলিং এর নানাদিক নিয়েই। এছাড়া নিজের ক্রিকেট দর্শন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও জাতীয় দল নিয়ে ভাবনার কথাও জানিয়েছেন এই অলরাউন্ডার।
খেলার কথায় যাওয়ার আগে আপনার নামের রহস্যটা জানতে চাই। মৃত্যুঞ্জয় নামটা কীভাবে আসলো?
মৃত্যঞ্জয় চৌধুরী নিপুণ: এই রহস্য আসলে আমিও ভেদ করতে পারিনি। তবে নামটা আব্বু রেখেছিল। আমিও আব্বুকে সেভাবে কখনো জিজ্ঞেস করিনি। তবে আমার ভাইয়ার জন্মের সময় একটা সমস্যা হয়েছিল। সে জন্মগ্রহণ করবে কী করবে না এমন একটা শঙ্কা ছিল। সেজন্যই পরে আমার নাম মৃত্যুঞ্জয় রাখা হয়।
আর নিপুণ নামটা?
– আমি জিজ্ঞেস করসি অনেকবার। আব্বুর এই দুইটা নামই নাকি অনেক পছন্দ। নিপুণ নামটাও আব্বুরই রাখা।
খেলায় ফিরি, চট্টগ্রাম মূলত আপনাকে ডেথ ওভারেই ব্যবহার করছে। তবে আপনি কোনটা বেশি উপভোগ করেন? নতুন বল নাকি পুরান বল?
– আমি আসলে বোলিংয়ে যখনই আসি তখনই এনজয় করি। এনসিএল যখন খেললাম তখন নতুন বলে বোলিং করেছি, বিসিএলেও নতুন বলে করেছি। আর এখানে হয়তো দলের প্রয়োজনে আমি নতুন বলে করতে পারছিনা। তবে আমি ডেথ ওভারে বোলিং করাটাও এনজয় করছি।
কিন্তু নতুন বলেও তা আপনার অনেক কিছু দেয়ার আছে চট্টগ্রামকে।
– হয়কি একটা বোলার যখন অনেকদিন ধরে বোলিং করতে পারেনা তখন বোঝার উপায় থাকেনা যে পেস, স্যুইং সবকিছু ঠিক আছে কিনা। আমিও ভাবছিলাম যে একটা ম্যাচে যদি নতুন বলে বোলিং দিত তাহলে খুব ভালো লাগতো। তবে টিমের যদি দরকার হয় আমি শেষের দিকে বোলিং করেও খুশি আবার যদিও পাওয়ার প্লেতেই তিন ওভার করতে হয় তাহলেও খুশি।
ডেথ ওভারে মনে হচ্ছে আপনি ব্যাটসম্যানদের শট খেলার প্রলোভন দেখিয়ে উইকেট গুলো নিচ্ছেন।
– বলতে পারেন। আমার একটা ভালো দিক হচ্ছে ব্যাটসম্যান কি করতে চাচ্ছে আমি সেটা বুঝতে পারি। ব্যাটসম্যানের সাথে একটা মাইন্ড গেমের মত খেলি। তবে ডেথে আমি সবসময় মাথায় রাখি কীভাবে ডট বল করা যায়। ডেথ ওভারে ব্যাটসম্যানের সামনে চ্যালেঞ্জ থাকে আমাকে মারার জন্য। এইটা আমার খুব এক্সাইটমেন্ট মনে হয়।
আর আপনি যেটা বলছিলেন, ডেথে আমি যখন বোলিং করি। তখন আমি অনেক সময় রিস্ক নেই। সেট ব্যাটসম্যানদের অনেক সময় বাউন্ডারিও দেই। তবে উইকেট পাওয়ার একটুও সম্ভাবনা থাকলে আমি সেটা কাজে লাগাই। কেননা নতুন ব্যাটসম্যান আসলে তাঁদের জন্য কাজটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
যেই ওভারটায় হ্যাটট্রিক হলো, সেটার প্রথম দুই বলেও কিন্তু আমি ১০ রান দিসি। এরপরই কিন্তু ব্যাটসম্যানরা শট খেলতে গিয়ে উইকেট দিল। আপনি আসলে ঠিকই বলেছেন, লোভ দেখিয়েই তো উইকেট গুলো পাচ্ছি।
সেট ব্যাটসম্যানের কথা বলছিলেন, আপনি তো দুই ম্যাচেই দুই সেট ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন। বিশেষ করে সাকিব সেদিন দারুণ ব্যাটিং করছিল। তাঁকেও আপনিই ফেরালেন। এই উইকেট গুলো পেলে বাড়তি ভালোলাগা কাজ করে কিনা?
– আসলে প্রত্যেকটা উইকেট পেলেই ভালো লাগে। যেমন মুস্তাফিজ ভাই (মুস্তাফিজুর রহমান) একটা কথা বলে যে ১ থেকে ১১ প্রত্যেকটা ব্যাটসম্যানের উইকেট পাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। আর সাকিব ভাইকে যখন আমি প্রথম বলটা করি তখন সে জোরে বল খেলতে একটু স্ট্রাগল করতেসিল। কারণ মাঝের ওভার গুলো স্পিনাররা করেছিল। তাই আস্তে (স্পিন) বল খেলতে খেলতে জোরে (পেস) বল খেলাটা কঠিন। আমি পরের বলে সেই সুযোগটাই নিই। সেটাও জোরে করি, আর সাকিব ভাই মিস টাইমিং করায় উইকেটটা পাই।
আচ্ছা, একটু বিপিএলের বাইরে যাই। শুনেছি বেন স্টোকস আর ডেল স্টেইন দুজনই আপনার খুব পছন্দের।
– হাহা, ঠিক। তবে বেন স্টোকসের ব্যাটিংটা মূলত আমার খুব ভালো লাগে। একটা পেস বোলার হয়ে সে যেভাবে ব্যাটিং করে সেটা অসাধারণ লাগে। আর ডেল স্টেইনের আগ্রাসী বোলিং আমার ভালো লাগে। তবে আমি আসলে কোন ক্রিকেটারকে আইডল মনে করিনা। আমি দশজনের থেকে দশটা ভালো দিক নিই।
হ্যাঁ, সবার ভালো দিক গুলো নিয়েই তো আপনি আমাদের মৃত্যুঞ্জয় হয়ে উঠবেন।
– একদম। আমি সবসময় চেষ্টা করি নিজের মত থাকার। অন্য কারো মত হলে তো আর আমি মৃত্যুঞ্জয় হয়ে উঠতে পারব না। আমি তো অন্য একজনের ছায়ার হয়ে থাকতে চাই না।
তাহলে মৃত্যুঞ্জয় কী হতে চায়? পেস বোলার নাকি অলরাউন্ডার?
– অবশ্যই পুরোপুরি অলরাউন্ডার হতে চাই। তবে বোলিং জিনিসটা আমার ন্যাচারাল। এটা আমার মধ্যে ছিল। আর ব্যাটিং এর জন্য আমি অনেক হার্ড ওয়ার্ক করেছি। যখনই ফাকা সময় পাই আমি ব্যাটিং নিয়ে কাজ করি। বোলিং নিয়েও অনেক কিছু শেখার আছে, তবে আমি মনে করি ব্যাটিং নিয়ে আমার শেখার জায়গাটা অনেক।
আমাদের তো একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডারের খোঁজ অনেকদিন ধরেই…
– হ্যাঁ আমি দুইটা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। অনেকে বলে দুইটা একসাথে করতে গিয়ে তুই হারায় যাবি। আমি এটা বিশ্বাস করিনা। কোন না কোনদিন তো আমি শিখবই। আমি হয়তো এখনো ব্যাটিংটা মূল ম্যাচে প্রমাণ করতে পারিনাই সেভাবে। যতটুকু করেছি ধরেন অনুশীলন ম্যাচে কিংবা নেটে। তবে চেষ্টায় আছি।
আচ্ছা, চট্টগ্রামে তো আপনার অনূর্ধ্ব ১৯ দলের তিন বন্ধু আছে। চারজন আবার একইসাথে খেলছেন। কেমন লাগছে?
– আমরা আসলে আগে যেমন ছিলাম এখনো তেমনই আছি। শরিফুল এখন আমার রুমমেট (হাসি…)। ক্রিকেটে অনেক সময় হয় যে এখন বাঁহাতি পেসার ভালো খেললে আরেকজন বাঁহাতি পেসার হিংসা করে। তবে আমাদের মধ্যে এসব নেই। শরিফুলের (শরিফুল ইসলাম) সাথে রুমে বসেই কিন্তু আমি কথা বলছি। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। এটাই আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছিল।
কিন্তু শরিফুল তো জাতীয় দলে ঢোকার ক্ষেত্রে এখন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী।
– (একটু হেসে…) আমি আসলে কাউকেই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করিনা। আমি যদি আমার সেরাটা দেই তাহলে কেন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে। আমার ব্যাটিং আছে, বোলিং আছে। আমি যদি দুইটাই ভালো করতে পারি আমি এগিয়ে থাকব।
জাতীয় দলে তাহলে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই জায়গা করে নিতে চাচ্ছেন?
– হ্যাঁ, আমি কিন্তু জাতীয় দলে অলরাউন্ডার হিসেবেই কম্পিট করতেসি। আমি ওই পেস বোলিং অলরাউন্ডারের জায়গাটা খালি করার চেষ্টা করতেসি। আমরা আসলে সবাই সবার চেয়ে ভালো খেলতে চাই। আমরা তো আসলে দেশের জন্য খেলি। আমার ভাই যদি আমার চেয়ে ভালো খেলে, তাহলে আমিও চাইব সেই খেলুক। দেশের হয়ে যে ক্যাপাবল সেই খেলবে। সবাই চায় দল জিতুক। সেটা যদি না হতো তাহলে কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটার কিন্তু অবসর নিত না। তাঁরা আরো খেলে যেতে পারতো।
শেষ প্রশ্ন, আপনি কী মনে করেন আপনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য প্রস্তুত?
– আসলে ভাই, ক্রিকেট এমন একটা জিনিস যে কখনোই কেউ পুরোপুরি রেডি না। বিরাট কোহলি কিন্তু এতগুলা রান করার পরেও নিয়ম করে প্র্যাকটিস করে।
না, নিজেকে নিয়ে কাজ করার বা উন্নতির জায়গাটা তো সবসময়ই থাকবে। কিন্তু আপনি প্রস্তুত কিনা?
– হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা কিন্তু সবাই মনে করি আমরা প্রস্তুত। আসলে জাতীয় দলে খেলাটা তো প্রতিটা ক্রিকেটারের স্বপ্ন। নিজের উপর আমি কখনো ডাউট করিনা। কারণ নিজের সবসময় কনফিডেন্ট থাকতে হবে যে হ্যাঁ আমি প্রস্তুত। বাদবাকি তো নির্বাচকদের হাতে। আর যেটুকু খারাপ হবে সেটা তো আমি নিজে কষ্ট করে ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করবো।