মুস্তাফিজুর রহমান। বিশ্ব ক্রিকেটে যার আবির্ভাব হয়েছিল অপার বিস্ময় নিয়ে । ছুটতে ছুটতে ক্রিজে এসে বাঁহাতটা উপরে তুলে অনেকটা আলতো করে ছুঁড়ে দেওয়া বাঁ-হাতি আঙুলের গ্রিপে সে সময় শুধু দেশীয় ক্রিকেট নয়, মজে গিয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটই।
আইপিএল, কাউন্টি একে একে ডাক আসতে শুরু করেছে, মুস্তাফিজের তুলনা দেওয়ার জন্যে তখন মিচেল স্টার্ক ছাড়া আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে বছর দুয়েক পর মুদ্রার উলটা পিঠ দেখতেও সময় লাগেনি মুস্তাফিজের। ইনজুরি থাবা তো বসলই, যেই না ফিরলেন সুস্থ হয়ে, হারাতে শুরু করলেন পুরোনো ফর্ম।
শোনা যায়, নিজেকে ফিরে পেতে নাকি বোলিং অ্যাকশনেও পরিবর্তন এনেছেন তিনি। তা কিছুটা আমরা বুঝতে পারি বটে। তবে তাতেও বিশেষ লাভ কিছুই হয়নি। মুস্তাফিজ এখনও উইকেট পান, তবে সেই উইকেট আর আগের উইকেটের মধ্যে পার্থক্য আছে বেশ। মায়াবী কাটার মাস্টার আকাশ থেকে ঝরে পড়লেন টুপ করে, এর কারণই বা কি?
আজকের লেখাটাও অনেকটা ‘মুস্তাফিজ ইজ ব্যাক’ ঘরানার লেখা যেত। কিন্তু গত কয়েক বছরে মুস্তাফিজ এতবার ফিরে এসেছেন যে সেই ফিরে আসাটা ঠিক ঘটা করে আয়োজন করতে মন চায়না। অন্তত, আমরা তো এই মুস্তাফিজকে চাইনি, দেখিনি, পরখ করিনি!
মুস্তাফিজের রঙ হারানোর শুরুর সাথে তার ক্যারিয়ারের শুরুর সময়টার একটা সম্পর্ক আছে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই শুধু কাটার দিয়ে তিনি এত বেশি উইকেট পেয়েছেন, এত দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়কে প্যাভিলিওনে ফিরিয়েছেন যে মুস্তাফিজ হয়তো ভুলেই গেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে হলে শুধু স্টক ডেলিভারি দিয়ে টিকে থাকা মুশকিল, রাজ করা তো একেবারেই অসম্ভব।
এই ব্যাপারটি যে একেবারেই কেউ বুঝতে পারেনি তা নয়। বিরাট কোহলি বুঝেছিলেন, বলেছিলেনও। বলছি যে সিরিজটায় মুস্তাফিজের অভিষেক সে সিরিজটার কথা। বলা যায়, একা হাতে মুস্তাফিজ ভারতকে সিরিজ হারিয়ে দিয়েছিলেন। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, সুরেশ রায়না কার উইকেট তিনি পাননি। সবাই বিভ্রান্ত হয়ে ব্যাটের দিকে তাকাতে তাকাতে ফিরে গেছেন প্যাভিলিওনে । তবে মুস্তাফিজকে নিয়ে সবচাইতে সত্যি কথাটা সে সময় বলেছিলেন বিরাট কোহলি। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পুরনো হলে মুস্তাফিজকে খেলাটা একেবারেই কঠিন হবে না।’
সে সময় যেটাই মনে হোক না কেন, বিরাট কোহলি যে ঠিক বলেছেন তা এতদিনে আমরা বুঝে গেছি বেশ । ঠিক বলবেননাই বা কেন?
বাঁ-হাতি পেসারদের বলা হয় ক্রিকেটের সৌন্দর্য । সেই সৌন্দর্য চামিন্দা ভাসের বোলিংয়ে এক সময় পাওয়া যেত সবচাইতে বেশি। তবে সেই সৌন্দর্যের প্রদর্শনী হয় সবচাইতে বেশি যে অস্ত্রে তা হল বাঁহাতি বোলারের ডেলিভারিতে বল পিচ করে ভেতরে ঢুকে যাওয়াতে। এই ভিতরে ঢুকে যাওয়া ডেলিভারিটাই একজন বাঁহাতি পেসারের সবচাইতে বড় অস্ত্র। আর এই অস্ত্রটাই মুস্তাফিজ আয়ত্ত করতে পারেননি একেবারেই!
শুরুর দিনগুলিতে মুস্তাফিজ যখন কাটারে রাজ করে চলেছেন, তখনই নিজের শক্তির জায়গাটায় কাজ করলে হয়তো ধীরে ধীরে হয়ে উঠতেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ত্রাস। বাংলাদেশও তাদের বোলিং ইউনিটে পেত একজন এক্স-ফ্যাক্টর বোলারকে । কিন্তু তা হয়নি, মুস্তাফিজ দিনের পর দিন চালিয়ে গেছেন এক কাটারেই। পারফর্ম্যান্সের গ্রাফ আস্তে আস্তে নিচে নেমেছে, মুস্তাফিজকে ছাড়া বাঁচা শিখতে পারেনি বলেই স্রেফ একাদশে নাম থেকে তাঁর।
তবে মুস্তাফিজের ভ্রম ভাঙতে সময় লাগেনি। কোর্টনি ওয়ালশের বিদায়ের পর দায়িত্ব নিয়েছেন ওটিস গিবসন। কট্টর হেডমাস্টার ধাঁচের এই কোচ দায়িত্ব নিয়েই কাজ শুরু করেছিলেন মুস্তাফিজের এই ভেতরে ঢোকা ডেলিভারি নিয়ে। মুস্তাফিজও চালিয়ে যাচ্ছিলেন গুরুর দেওয়া দীক্ষার অনুশীলন। ঠিক তখনই আঘাত হানে এই করোনা। অনুশীলন যায় থেমে, বাঁহাতি পেসারের এই সবচাইতে বড় অস্ত্রটা আর শেখা হয়না মুস্তাফিজের।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নানা সময়ে শোনা গেছে, লকডাউনেও গুরুর দেওয়া অনুশীলন নাকি চালিয়ে গেছেন মুস্তাফিজ। শ্রীলঙ্কা সফরকে সামনে রেখে যে ক্যাম্প হয়েছিল, সেখানেও নাকি চর্চা করেছেন এই অস্ত্রের। তবে তাতে খুব বেশি কাজ হয়েছে বলে মনে হয়না। স্পট বোলিং খুব বেশি না করলে তাতে কাজ হবার সম্ভাবনাও নেই।
মুস্তাফিজকে নিয়ে হয়তো আপনি আবার আশাবাদী হতে পারেন, গত ক’দিন বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের পারফর্ম্যান্স আপনার সেই আশার গ্যাসবেলুনে আরো হাওয়া যোগাতে পারে। তবে তেতো সত্যি, এই আশাবাদ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিয়ে চুপসে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। গতদিন মুস্তাফিজ যে কয়টি উইকেট পেয়েছেন তার সব কয়টিই লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানের। গত বিশ্বকাপেও তিনি যে উইকেটগুলো পেয়ে উইকেট শিকারীর তালিকায় চলে গেছিলেন, সেই উইকেটগুলোও ছিল লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানের। আর এই উইকেটগুলোর বেশিরভাগই মুস্তাফিজ পেয়েছেন স্টক ডেলিভারিতে।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানেরা (যাদের অনেকেই আসলে বোলার) মুস্তাফিজকে নিয়ে কাঁটাছেড়া করে মাঠে নামেন না , যেটা নামেন টপ অর্ডার কিংবা মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানেরা । তাই স্টক ডেলিভারি দিয়ে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানের উইকেট পাওয়া যেতে পারে। তবে সেই উইকেট পেতে গিয়ে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের কাছে বেদম মার খাওয়ার সম্ভাবনাও প্রচুর। আর তাছাড়াও, শুধুই লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানের উইকেট নেওয়ার জন্যে কোনো বোলারকে কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কেউ একাদশে রাখবে?
তাবৎ ক্রিকেটপ্রেমীর আশা মুস্তাফিজ তাঁর পুরনও ছন্দে ফিরবেন। হয়তো সেই চাওয়াটা মুস্তাফিজেরই সবচাইতে বেশি। তবে মুস্তাফিজ সেই চাওয়া মোতাবেক সায় দিচ্ছেন তো? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা একেবারেই কঠিন। সেই কঠিনেরে মুস্তাফিজ নিজ হাতেই যে কঠিনতর করে দিচ্ছেন তা কি তিনি টের পাচ্ছেন?
নানা সময়ে টিমের কাছে নিজের ইঞ্জুরী লুকানোর খবর আমরা পেয়েছি, মুস্তাফিজের শরীরি ভাষাও ঠিক মাঠে থাকছে না- এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি গত ভারত সফর পর্যন্ত। এই অভিযোগ কোন ক্রিকেটপ্রেমীর নয়, এই অভিযোগ ধারাভাষ্যকারের, ক্রিকেট বিশ্লেষকদের।
তবে সেই শরীরি ভাষায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে। এই শরীরি ভাষা জিইয়ে আরো বাড়ুক মুস্তাফিজের। হাজারতম বারের জন্যে নয়, শেষবারের মত ফিরে আসুক মুস্তাফিজ। যে মুস্তাফিজকে আমরা চিনি, চেনে সারা ক্রিকেটবিশ্ব।