অলক্ষ্যে চুপি চুপি হাস তুমি

অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা আর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে নিজেকে ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মালান। তবে, মজার ব্যাপার হল তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে ঠিক ‘হট কেক’ নন। বিগ ব্যাশ, পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) বা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) খেলে ফেললেও এখনও তাঁকে দেখা যায়নি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল)।

বাবা ছিলেন ক্রিকেটার, খেলেছেন ইংল্যান্ড প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। বাবার ক্রিকেট ক্যারিয়ার সাদামাটা, তেমন বেশি রাঙাতে পারেননি। কিন্তু বাবাকে ছাড়িয়ে গেছেন ছেলে ডেভিড মালান, ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের গণ্ডি পেরিয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।  ব্যাট হাতে দারুণ নৈপুন্যে টি-টোয়েন্টি র‍্যাকিং শীর্ষ স্থান দখল করেছেন মাত্র ১৯টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে।

ইংল্যান্ডের হয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর গড়টা অস্বাভাবিক। ৫৩.৪৩ গড়ে রান করেছেন ৮৫৫। একটি সেঞ্চুরির সাথে আছে ৮টি হাফ সেঞ্চুরি। ২০১৭ সালে নেপিয়ারে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন অপরাজিত ১০৩ রানে ইনিংস। যা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে একমাত্র সেঞ্চুরি তার।

সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে ছিলেন অতিমানবীয়। তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে খেলেছেন ম্যাচ জয়ী ৫৫ রানের জ্বলজ্বলে এক ইনিংস। পরের ম্যাচে ছিলেন আরও অপ্রতিরোধ্য। অপরাজিত ছিলেন ৯৯ রানে।

ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করা মালান বেড়ে উঠেন দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০০৬ সালে ২০ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন মিডলসেক্সে। তার দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের জন্য এই সময়ের ভিতরে পরিচিত লাভ করেছিলেন ইংল্যান্ডে। কাউন্টি ক্রিকেটে মিডলসেক্সের হয়ে অন্যতম সেরা পারফর্মার মালান। মালান  টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছিলেন ২০০৮ সালে, সে বছর টি-টোয়েন্টি কাপে মিডলসেক্সের হয়ে ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নামেন মালান, ল্যাঞ্চশেয়ারের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে আলোচনার ঝড় তুলেন।

টি-টোয়েন্টি কাপে মাত্র ৫১ বলে সেঞ্চুরি করেন এই ব্যাটসম্যান। সেদিন ৫৪ বলে ১০৩ রান করে ফ্লিনটফের বলে আউট হন মালান। মাত্র ২১ বছর বয়সে মালান ব্যাটিং তাণ্ডব চালিয়ে ছিলেন এন্ডু ফ্লিনটফ, গ্লেন চ্যাপেল এবং ডোমিনি কর্কের বিপক্ষে।

ব্যাট হাতে মিডলসেক্সের অন্যতম সেরা পারফর্মার মালান, মিডলসেক্সের হয়ে খেলেছেন দীর্ঘ  ১৩ বছর। ২০১৮ সালে মিডলসেক্সকে ক্রিকেটের তিন সংস্করণের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাহাতি এই ব্যাটসম্যান। ২০১৯ সালে পাড়ি জমান ইউর্কশায়ারে। এখন পর্যন্ত তিনি টি-টোয়েন্টিতে মিডলসেক্সের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান, মিডলসেক্সের হয়ে ১২৭টি ম্যাচে খেলে রান করেছেন ৩২২৭।

২০০৮ সালে ছয় নম্বরে করা সেঞ্চুরিটি টি-টোয়েন্টিতে  এখনো পর্যন্ত তৃতীয় সেরা ইনিংস। ২০১৮ সাল পর্যন্ত যা ছিল ছয় নাম্বারে ব্যাট করতে নামা সর্বোচ্চ ইনিংস।

২০১৬ সালে ইংল্যান্ড লায়ন্সের হয়ে রেকর্ড ব্রেকিং ১৮৫ রানের ইনিংস। শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষে অপরাজিত ১৮৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন মালান। ১২৬ বলে ১৮৫ রান করেছিলেন এই ব্যাটসম্যান, যা ছয় বছরে আগের রবি বোপারার ১৬৮ রানের  রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। এতো দিন যা ছিল লিস্ট এ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।

রেকর্ড ব্রেকিং সেঞ্চুরির ফলে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের জন্য ইংল্যান্ড দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ঘরোয়া ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই পারফর্মারকে। সেই সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক হয় মালানের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের প্রথম ম্যাচেই খেলেন ৪৪ বলে ৭৮ রানের মারকুটে ইনিংস।

নিজের অভিষেক ম্যাচে মালান মাত্র ৩১ বলে হাফ সেঞ্চুরি হাকান। মালান ৭৮ রানের ইনিংসটি সাজান ১২টি চার এবং দু’টি ছক্কায়। যা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে  অভিষেক ম্যাচে সর্বোচ্চ।

নিজের প্রথম ম্যাচেই এলেক্স হেলসকে নিয়ে দ্বিতীয় উইকেটে ১০০ রানের জুটি গড়েছিলেন মাত্র ৬০ বলে।  যেখানে মালান একাই যোগ করেন ৬৯ রান আর হেলসে ব্যাট থেকে আসে মাত্র ৩১ রান। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মালান এমন ইনিংস খেলতে পারেন সেই সামর্থ্যের জানান দিয়েছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে, যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও।

২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত তিন জাতির টি-টোয়েন্টি সিরিজে ইংল্যান্ড দলে ডাক পান ডেভিড মালান। নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে ট্রান্স-তাসমান টি-টোয়েন্টি সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়। তিন জাতির এই টি-টোয়েন্টি সিরিজে চার ম্যাচে  মালান ৪৩ গড়ে তিন ফিফটিতে করেন ১৭২ রান। সে সিরিজে তিনি একমাত্র ইংলিশ ব্যাটসম্যান ছিলেন যে ১০০ এর বেশি রান করতে সক্ষম হন। এমন দারুণ পারফর্মেন্সর পরও প্রায় বছর দেড়েক পরে আবার টি-টোয়েন্টি খেলার সুযোগ পান মালান।

২০১৯ সালের নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে দিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ফিরেন মালান। এই সিরিজে ব্যাট দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করে নজর কাড়েন মালান। সিরিজের প্রথম ম্যাচে জয় পাওয়া ইংল্যান্ড,  হেরে বসে দ্বিতীয় এবং তৃতীয়। পর পর দুই ম্যাচ হারার ফলে পাঁচ ম্যাচের  টি-টোয়েন্টি সিরিজে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিল ইংল্যান্ডের, চতুর্থ ম্যাচে হারলে সিরিজ হারানোর ভয় ছিল। এমন এক ম্যাচে জ্বলছে উঠে ডেভিড মালানের ব্যাট, পেয়ে যান আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি।

নেপিয়ারে চতুর্থ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন অপরাজিত ১০৩ রানের ইনিংস, তার এই সেঞ্চুরির উপর ভর করে ইংল্যান্ডের টি২০ ক্রিকেটে পায় সর্বোচ্চ রানের সংগ্রহ। সে ম্যাচে নির্ধারিত ২০ ওভারে তিন উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড সংগ্রহ করে ২৪১ রান। মালান মাত্র ৪৮ বলে সেঞ্চুরি করেন, তার এই ইনিংসটি সাজান নয়টি চার এবং ছয় ছক্কায়। যা ইংল্যান্ডের হয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরি। বৃষ্টিবিঘ্নিত পঞ্চমটি হয় টাই, সুপার ওভারে গড়ায় ম্যাচ। সে ম্যাচে জয়লাভ করে ইংল্যান্ড। ফলে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতে ৩-২ এ।

২০২০ সালে ব্যাট হাতে দুরন্ত দুর্বার ছুটছেন মালান, ব্যাট হাতে অপ্রতিরোধ্য এই ব্যাটসম্যান। গেল আগস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে দারুণ ধারাবাহিক ছিলেন, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দারুণ ছন্দে ছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে করেছিলেন ১২৯। সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন তিনি। তার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও।

অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা আর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে নিজেকে ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মালান। তবে, মজার ব্যাপার হল তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে ঠিক ‘হট কেক’ নন। বিগ ব্যাশ, পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) বা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) খেলে ফেললেও এখনও তাঁকে দেখা যায়নি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল)।

ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম বিস্ময়কর ধারাবাহিক এই ব্যাটসম্যান ওয়ানডে খেলেছেন মাত্র একটি। ২০১৯ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় মালানের, একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে  নিজের অভিষেক ম্যাচ রাঙিয়ে তুলতে পারেননি মালান। সে ম্যাচে ৩০ বলে করেন মাত্র ২৪ রান। এ পর্যন্ত একটি ওয়ানডে খেলেছেন মালান।

ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ম্যাচের বেশি খেলতে না পারলেও ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণ টেস্টে ম্যাচ খেলেছেন ১৫ টি। ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের মতো অভিজাত সংস্করণেও বেশ ধারাবাহিক মালান। ইংল্যান্ডের হয়ে পনেরো টেস্টে ২৭.৮৪ গড়ে রান করেছেন ৭২৪। এক সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে ছয় হাফ সেঞ্চুরি।

বয়স এখন ৩৩-এর বেশি। এই অবস্থা থেকে হয়তো অনেক দূর যেতে পারবেন না মালান। তবে, যতদিন আছেন – হয়তো টি-টোয়েন্টির মালা জপেই যাবেন বাঁ-হাতি এই ব্যাটসম্যান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...