খিপরো থেকে করাচি: দীর্ঘ এক যাত্রা

করাচি থেকে ২৮৫ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট একটা মফস্বল শহর খিপরো।

শানগড় বিভাগের এই ছোট্ট শহরটির ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে ওঠে হায়দারাবাদ বা করাচি শহরে গিয়ে একটা চাকরি জোটানোর স্বপ্ন নিয়ে। এখান থেকে সাকলাইন মুশতাক হওয়ার স্বপ্ন খুব বেশী ছেলে দেখে না। কিন্তু তিনি সেই স্বপ্নটা দেখে ফেলেছিলেন। আর সেই স্বপ্নই তাকে তাড়া করে বেড়ালো জীবনভর।

লোকে বলে, অভাজনের স্বপ্নপূরণ হয় না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বয়স পার হয়ে গেছে, লোকেরা মন্দ বলতে শুরু করেছে; তারপরও তিনি স্বপ্ন ছাড়েননি। অবশেষে সেই স্বপ্নটা তার করতলে সত্যি হয়ে এসে দেখা দিলো। ৩৪ বছর পার করে এসে পাকিস্তানের জার্সি জড়ালেন শরীরে এবং সারা বিশ্বকে জানালেন, তিনি স্বপ্ন সত্যি করতে পারেন।

হ্যা, নোমান আলীর কথা বলছিলাম।

৩৪ বছর ১১২ দিন বয়সে পাকিস্তান দলের হয়ে টেস্ট অভিষেক হলো বাহাতি স্পিনার নোমান আলীর। প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট নিয়ে নিজের অস্বিত্বের জানান দিয়েছিলেন। আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে দ্বিতীয় ইনিংসে ২৪৫ রানে গুড়িয়ে দেওয়ার পথে নিলেন ৫ উইকেট। অভিষেকেই ৫ উইকেট নিয়ে এলিট ক্লাবে নাম লিখিয়ে ফেললেন ‘বুড়ো’ নোমান।

নোমানের জন্ম একেবারেই প্রত্যন্ত শহর খিপরোতে। বাবা ছিলেন একজন তেল কোম্পানির কেরানী; চাকরি করতেন হায়দারাবাদে। খুব কষ্টের না হলেও টানাটানির পরিবার। এখান থেকে করাচি কিংবা হায়দারাবাদে গিয়ে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখাটা কঠিন ছিলো। কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকেই নোমানের একমাত্র প্রেম ছিলো ক্রিকেট।

সেই প্রেমটা বাস্তবে রূপ পেলো চাচার জন্য। চাচা তাকে নিয়ে গেলেন হায়দারাবাদে। সেখানে একটা ক্রিকেট ক্লাবে যোগ হলেন নোমান। বাবার চাকরির সুবাদে থাকা খাওয়ার খুব কষ্ট হলো না। কিন্তু ক্রিকেটের মতো ব্যয়বহুল খেলা চালিয়ে যাওয়াটা সোজা ছিলো না। নোমান নিজে বলছিলেন, ‘সময়টা কঠিন ছিলো। আমাদের শহর থেকে হায়দারাবাদ এসে ক্রিকেটার হওয়াটা সোজা ব্যাপার নয়। আমার বাবা গেল কোম্পানির কেরানি ছিলেন। উনি অনেক কষ্ট করেছেন। তবে ক্রিকেটে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন চাচা।’

অবশ্য নোমানের একটা সুবিধা হলো, তিনি দ্রুত নিজেকে চেনাতে শুরু করলেন। ফলে হায়দারাবাদ হকস ও হায়দারাবাদ প্রথম শ্রেনীর দলে জায়গা পেয়ে গেলেন। ২০০৭ সালে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে গেলো নোমানের। এরপর নোমান পারফরম করতে থাকেন এবং সময় কাটতে থাকে। কিন্তু নোমানের স্বপ্ন যে জাতীয় দল, তার কোনো খোজ নেই।

আস্তে আস্তে সামনে থেকে চুল ফাঁকা হয়ে যায়, বয়সের ছাপ পড়ে, দিন গড়াতে থাকে। সমকালীন ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে খেলে ফেলেছেন। যারা সেপথে হাটেননি, তারা খেলা ছেড়ে চাকরি বা ব্যবসা শুরু করেছেন। নোমানকে লোকে জিজ্ঞেস করে, তিনি কবে ঘরমুখী হবেন?

নোমান নিরুত্তর থাকেন। কারণ, তিনি স্বপ্নটার শেষ না দেখে ছাড়বেন না। অবশেষে ২০১৮-১৯ মৌসুমটা স্বর্নপ্রসবিনী হয়ে আসে। নোমান তখন খান রিসার্চ ল্যাবরোটরিজের হয়ে খেলছেন।

সে বছরের কায়েদ-ই-আজম ওয়ানডে কাপে ৭ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হন। একই মৌসুমে প্রথম শ্রেনীর কায়েদ-ই-আজম ট্রফিকে ৮ ম্যাচে ৪৩ উইকেট নিয়ে হইচই ফেলে দেন। ওখান থেকেই আসলে তিনি নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে ফেলেন।

গত মৌসুমেও নোমান দারুন পারফরম করেন। সবমিলিয়ে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ৭৯ ম্যাচে ২৮৫ উইকেট! খুবই ঈর্ষনীয় পরিসংখ্যান। এমন একজনকে অবহেলা করাটা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা ছিলো, নোমানকে ঠিক ভবিষ্যত বিনিয়োগের জন্য সঠিক মনে করতে পারছিলেন না নির্বাচকরা। তাকে দলে নিয়ে দীর্ঘদিন সার্ভিস পাওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। অবশেষে সেই দ্বিধাও মুক্ত হলো।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট দলে ডাক পেলেন। কেবল ডাক পেলেন না, অভিষেকও হলো। প্রথম ম্যাচেই ৭ উইকেট নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তার ওপর বিনিয়োগটা ভুল ছিলো না। পাকিস্তানের অন্যতম বয়ষ্ক ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক হলো তার। নোমান বলছিলেন, তিনি জানতেন, এক সময় না এক সময় এই সুযোগটা আসবে, ‘আমি জানতাম, আমি একসময় সুযোগ পাবোই। গত দুই মৌসুম অনেক উইকেট পেয়েছি। ফলে এই ডাকটা পাবো বলেই ধারণা ছিলো।’

এখন পালা নোমানের নিজেকে ধরে রাখা। অনেকে অবশ্য বলছেন, দেশের বাইরে সিরিজ হলে এই সুযোগ আর পাবেন না। নোমান বলছিলেন, ‘দেশের উইকেট চেনা, তাই একটু সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী। আমি সুযোগ পেলে যে কোনো দেশের উইকেটেই ভালো করতে পারবো।’

তাই হোক। নোমানের জয়যাত্রা চলুক। নোমানের মাধ্যমে আমরা জেনে যাই যে, বয়সটা আসলেই একটা সংখ্যা মাত্র। লড়াই শুরু করার কোনো শেষ সময় নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link