ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে অভিষিক্ত কোন বাঁ-হাতি স্পিনারের অভিষেক ম্যাচেই উইকেট নেওয়ার শেষ ঘটনা ছিল ২০১২ সালে! আকিল হোসেনের মাথায় তাই ওয়ানডে ক্যাপ পরিয়ে দেবার সময় প্রত্যাশার পারদ যে খুব বেশি ছিল এমনটা ভাবা যাবেনা।
এমনিতেই তো দলটা গোছানো ছিল না, ম্যাচের আগেই এক রকম হার দেখেই মাঠে নেমেছিল তাঁরা। সেখানে আকিল হোসেন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের যে চ্যালেঞ্জটা দিলেন সেটাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট একটু আশার আলো হিসেবেই দেখতে পারে! সুলেমান বেনের পর যে বাঁহাতি স্পিনারদের ব্যাটনটা আর কেউ নিতে পারেনি উইন্ডিজ ক্রিকেটে!
একটু পিছিয়ে শুরু করা যাক তাহলে। আকিল জেরোমে হোসেনের জন্ম পোর্ট অফ স্পেনের ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোতে। উইন্ডিজ ক্রিকেটে তরুণ প্রতিভার রসদ সবসময়ই পুর্ণ থাকে। সেরকই এক তরুণ প্রতিভা ছিলেন আকিল হোসেন।
আর তাই তো ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলেও ছিলেন তিনি। সে বিশ্বকাপের বছরেই অভিষেক হয়ে যায় ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের আঞ্চলিক চার দিনের টুর্নামেন্টে। জ্যামাইকার বিপক্ষে সেই যে ত্রিনিদাদের হয়ে শুরু, শুরু থেকেই সাফল্য দেখতে লাগলেন আকিল।
উইন্ডওয়ার্ড আইল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ৬/৩৩ আর ৫/৩৪ ফিগারে বোলিং করে হয়ে গেলেন ম্যান অফ দা ম্যাচ। তবে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেক আসরেই চমক দেওয়ার তখনও বাকি আছে আকিলের। উইন্ডওয়ার্ড আইল্যান্ডের পরের ম্যাচটা ছিল লিওয়ার্ডের বিপক্ষে। সে ম্যাচেও আকিল বনে গেলেন ম্যান অফ দা ম্যাচ। তবে এবার আর বল হাতে নয়, জ্বলে উঠেছিলেন ব্যাট হাতে- অপরাজিত ছিলেন ১০২ রানে।
এরপরই যাকে বলে কপাল খুলে যায় আকিলের। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (সিপিএল) এর ২০১৪ আসরেই দল পেয়ে যান, সুযোগ পান ২০১৪ এর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টিতেও। সিপিএলের পরের আসরেও দল পেয়ে গেলেও ততদিনেও ৫০ ওভারি টুর্নামেন্টে নাম লেখানো হয়নি আকিলের। দ্রুত প্রথম শ্রেণির অভিষেক, এরপর টি-টোয়েন্টিতে দল পেয়ে যাওয়া- আকিলের অপেক্ষাটা ওয়ানডের জন্যে বাড়ছিলই।
তা সেই অপেক্ষার অবসান হয়েছে ২০১৯ এ এসে। ২০১৯ এর নভেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫০ ওভারের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আঞ্চলিক সুপার ফিফটিতে ত্রিনিদাদ দলে জায়গা পান তিনি। তবে সাদা বলের এ সুযোগ কিন্তু আকিলকে লাল বলের জন্যে একদমই পিছিয়ে দেয়নি।
আঞ্চলিক যে চার দিনের টুর্নামেন্টের কথা বলছিলাম, সেটারই ২০১৯-২০২০ আসরে তিনি একাই নেন ৩৬ উইকেট। তবে এরপর আবার সাফল্যে ভাসার মত পারফরম্যান্স তিনি করেন ২০২০ সালের সিপিএলে। ত্রিনবাগো নাইট রাইডার্সের হয়ে সে আসরে তিনি ১০ উইকেট নিয়ে দলকে শিরোপা জেতাতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
আকিল হোসেন দলে এসেছেন এমন একটা সময়ে যখন উইন্ডিজের বেশিরভাগ খেলোয়াড় খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে সত্যি বলতে, আকিল হোসেনকে এমনিতেই খেলানোর একটা পরিকল্পনা ছিল। উইন্ডিজের মূল দলটাও যদি খেলতে আসত, বাংলাদেশের ধীরগতির পিচের কথা মাথায় রেখে আকিলকে দলে নেওয়াই হত। এর কারণ হিসেবেও সাক্ষ্য দেয় আকিলের পরিসংখ্যান।
লিস্ট-এ ক্রিকেটে তিনি ২৯ ম্যাচ খেলে ২২.৭৫ গড়ে নিয়েছেন ৪০ উইকেট। ইকোনমিটাও কিন্তু ঈর্ষা জাগানিয়া- ৩.৮২! ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেই প্রথম অভিষেক হওয়া আকিল এ ফরম্যাটে নিয়েছেন ২৩ ম্যাচে ৬৩ উইকেট- ইনিংসে ৫ উইকেট আছে ৩ বার!
যা হোক, আকিলকে দলে নিয়ে যে ভুল করেনি উইন্ডিজ সেটা তো তিনি প্রথম ওয়ানডেতেই প্রমাণ করেছেন। ১০ ওভার হাত ঘুরিয়ে ২.৬ ইকোনমিতে ৩ উইকেটই শুধু নয়, আকিল যেভাবে বল করেছেন সেটাই ছিল দুর্দান্ত।
এখানে দেখা যাচ্ছে, সাকিব আর আকিল দুজনই ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্যে বল করেছেন ফুল লেন্থ আর গুড লেন্থে। কালকের পিচ ছিল এমনিতেই ধীরগতির। স্পিনারদের বল ফেলার আদর্শ জায়গাই ছিল গুড লেংথ। সাকিবের মত আকিলও হেটেছেন তাই সে পথেই।
ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে যে উইকেটটি তিনি নিয়েছেন, সেটাও নিয়েছেন গুড লেংথেই। আরেকটা ব্যাপার এখানে দেখা যাচ্ছে- আকিলের লাইন! তিনি বল ফেলেছেন একেবারের উইকেট বরাবর। কালকের পিচে যে টার্ন ছিল, আর আকিল যেভাবে টার্ন করাচ্ছিলেন তাতে এই লাইন মেনে বল করাটাই ছিল সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ।
এছাড়াও, কাল যদি খেলা দেখে থাকেন একটা ব্যাপার নজরে পড়তে বাধ্য। আকিলের বলগুলো বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের জন্যে বামে আর ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্যে ডানে মোড় নিচ্ছিল। দুইদিকে এই বল ফেলার ব্যাপারটাও কিন্তু আকিলকে শুরু থেকেই সাফল্য এনে দিতে বাধ্য করেছে।
বাঁহাতি স্পিনার হয়েও বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে কিন্তু আকিল যথেষ্ট সফল বলতে পারি আমরা। ব্যাটসম্যান বদলালেও তিনি তাঁর বলের লেন্থ ধরে রেখেছিলেন পুরোদমে। তবে এবার বলের লাইনটাকে একটু সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের জন্যে অফসাইডে বল ফেলে কখনও সেই বলকে ভিতরে ঢুকিয়েছেন, কখনও বা বল ডানে টার্ন করে আরো অফ সাইডে চলে গেছে। একজন বাঁহাতি অর্থোডোক্স স্পিনার হয়েও তিনি দুটি উইকেট নিয়েছেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে, যে দুটি উইকেটের একটি আবার আরেক বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসানেরই!
আকিল এ ধরণের পিচে যেভাবে বল করছেন, তাতে বাংলাদেশ আকিলকে নিয়ে আরেকটু সতর্ক হতেই পারে। এখনও তিনি টেস্ট দলে ঢোকেননি, তবে এভাবে বোলিং করতে থাকলে উইন্ডিজ সম্ভবত তাকে সাদা পোশাকেও অন্তর্ভুক্ত করে ফেলবে। এতে বাংলাদেশ জয়ের জন্যে আবারও র্যাংক টার্নার বানালে বাংলাদেশকে খেলতে নামতে হবে আকিলের ব্যাপারে আরেকটু কেস স্টাডি করেই!