ভারতের এখন কোনো স্টক বোলার নেই!

অদ্ভূত এক সমস্যা দেখছি ভারতীয় ক্রিকেটে – ব্যাটিং অলরাউন্ডারের অভাব। এমন কি ‘ব্যাটার হু ক্যান বোল ইফ রিকোয়ার্ড’ ধরণের ক্রিকেটারও নেই বললেই চলে। রবীচন্দ্রন অশ্বিন, রবীন্দ্র জাদেজা, শার্দুল ঠাকুর আছেন, কয়েকদিন আগে অবধি হার্দিক পান্ডিয়াও ছিলেন। কিন্তু এঁরা বোলিং অলরাউন্ডার। মূলত বোলার হিসাবেই জায়গা পান। ব্যাটিং তালিকায় ৬ নম্বরের পরেই আসেন। আমার লক্ষ্য ১-৫ নম্বরে নেমে রান এবং ষষ্ঠ-সপ্তম-অষ্টম বোলারের কাজ করা।

টেস্ট ক্রিকেটের কথা এই পোস্টে বলছিনা। যদিও মুলতানে মঈন খানকে গুগলিতে বোল্ড করে পাকিস্তানের স্বপ্ন শেষ করেন শচীন। আর সৌরভ তো ১৯৯৮ ইডেন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বোলিং ওপেনও করেছেন।

ওয়ান ডের ক্ষেত্রে এই রিজার্ভ বোলারের গুরুত্ব অন্তত এই গ্রুপে কাউকে বলে বোঝাতে হবে না। জুটি ভাঙার ক্ষেত্রে বা কয়েক ওভার মূল বোলারকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য, বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্টক বোলারের জবাব নেই।

ওয়ানডের ক্ষেত্রে, বিগত পঞ্চাশ বছরের ভারতীয় দলের দিকে তাকানো যাক। সাতের দশকে ভারতীয় দল ওয়ান ডে ক্রিকেটে তেমন কিছু করতে না পারলেও, প্রথম অর্ধে মদনলাল, মহিন্দর অমরনাথ ছিলেন। পরবর্তী অর্ধে কপিল দ্য গ্রেট আসেন। যাঁর তুল্য অলরাউন্ডার উপমহাদেশে কাউকেই পাচ্ছিনা। ইমরান খান বা ওয়াসিম আকরামের (বুকে পাথর রেখেই বলছি) কপিলের পরে আসবেন।

আশিতে আসি। কপিল দেব-মদন লাল-মোহিন্দর অমরনাথ-রবি শাস্ত্রী-কারসন ঘাউড়ি। এইবার মজাটা দেখুন। সেমি ফাইনালে প্রথম পাঁচ বোলার ছিলেন, কপিল-সাঁধু-মদন-বিনি-কির্তী। মোহিন্দর অমরনাথ ষষ্ঠ বেলার হিসাবে এসে ডেভিড গাওয়ার, মাইক গ্যাটিং এর উইকেট তুললেন। আবার তিন নম্বরে ব্যাট করে ৪৬ রান করলেন। বলা ভালো ৫০-২ থেকে দলকে নিরাপদে পৌঁছে দিলেন।

ফাইনালেও ব্যাটে দূর্গ বাঁচিয়ে বল হাতে দুঁজো-মার্শালের অ্যাডভ্ঞ্চার থামিয়ে দিলেন। ১৯৮৫ সালে ব্যাটিং ওপেন করা রবি শাস্ত্রী প্রতিটি ম্যাচেই ষষ্ঠ বোলার (ফাইনালে পঞ্চম) হিসাবে ১০ ওভার বল করেছিলেন। আশি নিয়ে এর বেশী তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, খেলা দেখিনি। ক্রিকইনফোর ভরসায় আর কি চলে? আর স্কোরবোর্ড দেখে ক্রিকেট বিচার হয়না।

নব্বই নিয়ে নাড়াচাড়া করি। ভারতীয় দলে মোটামুটি প্রথম পাঁচ বোলার -মনোজ প্রভাকর, জাভাগাল শ্রীনাথ, কপিল দেব -১৯৯৪ অবধি পরে ভেঙ্কটেশ প্রসাদ, অনিল কুম্বলে, ভেঙ্কটপতি রাজু/ রাজেশ চৌহান। এছাড়াও ডোডা গণেশ, আবে কুরুভিল্লারা মাঝেমধ্যে খেলেছেন। রবিন সিং ছিলেন আদর্শ ছয় নম্বরের অলরাউন্ডার।

লক্ষ্যণীয়, মনোজ প্রভাকর বাদে সকলেই ৬ নম্বরের পর ব্যাট করতে নামতেন। মনোজ প্রথম দিকে ওপেন করতেন। সেঞ্চুরীও করেন। এরপর ব্যাটিং অর্ডারের দিকে তাকানো যাক। শচীন টেন্ডুলকার যথেষ্ট বড় বোলার। প্রথম দিকে রবি শাস্ত্রী ছিলেন। তাছাড়া স্টক বোলার হিসাবে অজয় জাদেজা। ১৯৯৬ সালে সৌরভ গাঙ্গুলি আসেন। ফলে স্টক বোলার আরও বাড়ে।

একটি ম্যাচের উদাহারণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। হিরো কাপ সেমিফাইনাল। এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। ষষ্ঠ বোলার হিসাবে জাদেজা এসে দুটি উইকেট নিলেন। শেষ ওভারে ৬ রান বাকি। ক্রিজে ব্রায়ান ম্যাকমিলান। সপ্তম বোলার হিসাবে ম্যাচের শেষ ওভারে বল করতে এলেন শচীন টেন্ডুলকার। তারপর ইতিহাস।

আরেকটা উদাহারণ দেবো। ১৯৯৭ সালের সাহারা কাপ। অনিয়মিত বোলার হিসাবে বল করতে এসে সৌরভ হয়ে উঠলেন অধিনায়ক শচীনের ভাষায় ‘সিক্রেট ওয়েপন’।

১৯৯৮ সালে ঢাকায় ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ’ প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচটি মনে করা যাক। সপ্তম বোলার হিসাবে বল করতে এসে ইনজামামের তাণ্ডব থামিয়ে দিলেন শচীন টেন্ডুলকার। প্রথম ফাইনালেও ষষ্ঠ বোলার হিসাবে শচীন তিনটি উইকেট নেন।

এই শতাব্দীর প্রথম দশ বছরেও ব্যাটিং অলরাউন্ডাররা বোলিং য়ের গভীরতা কতটা বৃদ্ধি করেছিলেন দেখা যাক। শচীন-সৌরভ প্রায় নিয়মিত বোলার তখন। দুজনেই আবার ব্যাটিংয়ে ওপেন করতেন। ফলে অতিরিক্ত ব্যাটসম্যান নেওয়া যেত। দ্রাবিড়কে লোক নম্বরে নামিয়ে ব্যাটিং গভীরতা বাড়ত। সাথে চারজন বোলার।

আবার স্টক বোলার যুবরাজ সিং। মানে সাতজন বোলার। বীরেন্দ্র শেবাগ আসার পর সংখ্যাটা আট হয়। ফলাফল? তিনটে আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা (একটিতে যুগ্মজয়ী)। পরে ইরফান পাঠান রেগুলার বোলার হয়েও ব্যাট করতে পারায় সুবিধা হয়েছিল। পরে ইউসুফ পাঠান ও বল করতে পারতেন।

একটা উদাহারণ দিই। এই গ্রুপে প্রায় সবার মনে আছে। ২০০২ চ্যাম্পিয়ানস ট্রফি সেমি ফাইনালে ভারত প্রথমে ব্যাট করে ২৬১ করে। দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাট করতে নেমে ৩৮ ওভারে ১ উইকেটে ১৯২ করে। গিবস ১১৬ রানে আহত ও অবসৃত হন। উল্টোদিকে জ্যাক কালিস ৯৭ রানে অপরাজিত।

এর পরেও জন্টি-ডিপেনার-বাউচার-ক্লুজনার-পোলক। ম্যাচ ভারতের হাত থেকে বহু আগেই বেরিয়ে গেছে। অষ্টম বোলার হিসাবে বল করতে এসে বল করতে এসে ৩ টি উইকেট নিলেন বীরেন্দ্র সেহবাগ। হরভজনের দুটো উইকেট বা যুবির ক্যাচ মাথায় রেখেও বলছি, ঐ ম্যাচে সেগবাগের বল না থাকলে ম্যাচ ভারত জিততো না।

গত দশকের প্রথম দিকে যুবরাজ সিং বা সুরেশ রায়না কিছুটা সামলাতেন। যুবরাজ তো ২০১১ সালের বিশ্বকাপে নিয়মিত উইকেট নিতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারপর? শুধুই হতাশা। এখনও হয়ত তেমন দিন আসেনি যেদিন জয়াসুরিয়া-আফ্রিদি-গিলক্রিস্ট-হেইডেন-সোহেল-আনোয়ারদের মতো শুরু থেকেই ধ্বংসশলীলা চালাবেন কোনও বিপক্ষ ব্যাটার। ১২ ওভারে ১০০+ উঠে যাবে। হাতে অপশন নেই। বা দিন ওভারের মাথায় ফলো থ্রু ক্যাচ নিতে গিয়ে চোট পাবেন প্রথম দিকের কেনও বোলার। তারপর? তার আর পর নেই, নেই কোনও ঠিকানা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link