লম্বায় তো বেশ খাটো। তবে শারীরিকভাবে অন্যান্য গঠনে রিজওয়ান নিতান্তই একজন আঁটসাঁট ব্যক্তিত্ব। চেহারায় মলিনতা চুয়ে চুয়ে পড়ে। নেই সেখানে আগ্রাসী ভাবের ছিটেফোঁটা একেবারেই। তাই, তাঁর মাঝে থাকা আত্মবিশ্বাস প্রথম দেখায় নজরে আসেনা কারোই।
পড়ে থাকতে হয় আলোচনার বাইরেই, আলোচনা না হোক! সমালোচনা তো আর পিছু ছাড়েনা। অবশ্য, মাঠের ক্রিকেটের কাউকে আলোচনায় আসতে হলে, মাঠেই কিছু করতে হয়। রিজওয়ান তা পারছিলেনও না বটে। সেক্ষেত্রে আলোচনায় না থাকাই সুষ্ঠ বিচার তাঁর বেলায়। টেস্ট ও ওয়ানডেতে অল্পস্বল্প রান করলেও টি-টোয়েন্টি ছিলেন পুরোদস্তু আগন্তুক একজন।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, রিজওয়ান পাকিস্তানের অন্যতম সেরা প্রতিভা হিসেবে সর্বমহলে আলোচিত হলেও দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিলেন সাবেক অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদের কারণে। যেহেতু, রিজওয়ান নিজেও একজন উইকেটরক্ষক। অধিনায়ক সরফরাজ ছিলেন তখন দলের অটোচয়েজ তবে কাণ্ডারি নন। আর রিজওয়ান একজন উঠতি তরুণ, যে কিনা পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছে জাতীয় দলে স্থান। যদিও, অধিনায়কত্বে দলকে চ্যাম্পিয়ন’স ট্রফি জিতিয়েও পছন্দের পাত্র হতে পারেননি সরফরাজ তেমন কারোই।
রিজওয়ান নিয়মিত সরফরাজের কাছে জায়গা হারাতেন, এরমাঝে দলে সুযোগও মিলতো কালেভদ্রে। যদিও, ব্যর্থ হতেন নিজেকে প্রমাণে। নামের প্রতি সুবিচার করা কতোই না কঠিন, তা কেবল রিজওয়ানই জানেন। দেশে কিংবা বিদেশে সব মাঠেই ব্যর্থতার পাল্লা বেশ ভারি ছিলো তার। ওয়ানডে অভিষেকে মিরপুরে অর্ধশতকের সুখস্মৃতির পাশাপাশি টেস্ট অভিষেকে আছে নিউজিল্যান্ডের মাঠে সোনালী হাঁসের দু:সহ স্মৃতিও।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইশ গজ অচেনা আচরণ শুরু করে তার সাথে। অবশ্য, এগুলোই পরবর্তীতে একজনকে পরিণত হওয়ার পথ বাতলে দেয়। টেস্ট ও ওডিআই দুই ফরম্যাটেই রিজওয়ানের পারফরম্যান্স ছিলো থেমে থেমে। সামর্থ্য জানান দিলেও, যেতে পারেছিলেন না সামর্থ্যের সর্বোচ্চ চূড়ায়। আবার, ম্যাচে তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানের কারণে বাদ দেওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি কখনও পুরোপুরি। টি-টোয়েন্টিতে নিজেকে হারিয়েছেন বারবার। নিজেকে খোঁজার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, নজরে আসেনি তার প্রয়াস।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাকে চূড়ান্তভাবে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া নিয়েও তুমুল আলোচনা চলছিলো। তখনই স্বরূপে আবির্ভাব রিজওয়ানের কিউইদের মাঠে তাদেরই বিপক্ষে। কাইল জেমিসন ক্রিকেটের পেস বোলিং চাকায় নতুন গতি দিয়েছে। নতুন করে শক্তি জুগিয়েছে কিউই পেস বোলিংয়ে। সেই জেমিসনকে তুলোধুনো করে দিশেহারা করে ছাড়লেন। সীমনা ছাড়া করতে কার্পণ্য করেননি।
ট্রেন বোল্টের শৈল্পিক আগ্রাসী বোলিংকেও আমলে নিলেন না। পুরো কিউই বোলিং লাইন-আপকে পাড়ার বোলিং বানিয়ে মাঠের রাজত্ব সেদিন একা রিজওয়ানের। ৫৯ বলে ৮৯ রানের ইনিংসে দলকে বাঁচালেন ধবল ধোলাইয়ের লজ্জা থেকে। সেদিনের পুল শটগুলো যারা দেখেছেন!
কেবল তারাই বলতে পারবেন রিজওয়ানের আগ্রাসনের মাত্রাটা কোন পর্যায়ের ছিলো। এই ইনিংসকে বিবেচনা করা চলে স্বপ্নের সাথে। অসাধারণ পাওয়ার হিটিংয়ের সক্ষমতার পাশাপাশি আছে রানের চাকা সচল রাখতে বাইশ গজে নিয়মিত প্রান্ত বদলের দক্ষতাও। চার-ছয়ে রান বের করা কঠিন হয়ে গেলে সিঙ্গেলস থেকে ডাবল বের করা কোনো ব্যাপারই নয় তাঁর কাছে।
কিউইদের মাঠে তাদের বেসামাল করে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। অন্যদিকে, সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পিছিয়ে থাকা রিজওয়ানের জন্যে তো — তা ছিলো অসম্ভব ব্যাপার-স্যাপার। কিন্তু, রিজওয়ান সেই অসম্ভবটাই সম্ভবে রূপ দিয়ে ছাড়লেন। তাক লাগালেন ক্রিকেট বোদ্ধাদের। অথচ এর আগের ২৬ টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ১৮ ইনিংসে মাঠে নেমেও ছিলেন সাদামাটা একজন। ছিলোনা কোনো অর্ধশতকও। উল্লেখ্য, স্ট্রাইকরেট ছিলো অতি জঘন্য। তাই আগন্তুক বললে ভুল বলা হলো বলে মনে হয়না।
এরপরের ১৩ ইনিংস কেবলই ঈর্ষা জাগানিয়া। ১৩ ইনিংসে ৮ অর্ধশতকের পাশাপাশি একটি শতকও। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরে ও বাইরে পরপর দুই টি-টোয়েন্টি সিরিজে রিজওয়ানের সাফল্য ধরা দেয় অনায়াসেই। তিন অর্ধশতকের পাশাপাশি এক শতক। রিজওয়ানের ব্যাট চলেছে তলোয়ারের ভঙ্গিতে।
বৈরী পরিবেশেও রিজওয়ান এখন মূর্তিমান ত্রাস। যে মাঠে থাকলেই আতঙ্ক প্রতিমূহুর্তে বিপক্ষ দলের। রিজওয়ান বেশ উপভোগ করেন তার এই ব্যাটিং। মুখভর্তি হাসিটাও তাই এখন আগের চেয়েও চওড়া তার। দুঃসময় পার করে সুসময়ে পদার্পণের হাসিটা চওড়া না হয়ে কি আর উপায় আছে ?
সবশেষ গল্পটা জন্ম দিয়েছেন ট্রেন্ট ব্রীজে। করোনা মোকাবেলা করে শক্তিশালী দল নিয়ে পাকিস্তানের মুখোমুখি হলেও কূল-কিনারা করতে পারেনি দুই ওপেনার বাবর-রিজওয়ানের দাপটে। ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে ইংলিশ বোলারদের খাইয়েছেন নাকানি-চুবানি।
বাবরকে নিয়ে ১৫০ রানের জুটি। দলের শক্ত ভিত গড়ার জন্য একটি আদর্শ জুটি। নিশ্চয়ই বুঝতে আর দেরি নেই যে, ৮ অর্ধশতকের শেষটি ট্রেন্ট ব্রীজেই হয়েছে। দৃঢ়-প্রত্যয়ীরা সফল হবেই, তা দেরিতে হলেও। একবার সফল হলে সেই ধারা অব্যাহত থাকবে অসংখ্য দিন। রিজওয়ান সম্ভবত সেই পথেই এগোচ্ছেন।
২০২১ সালে রিজওয়ান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ‘হট কেকের’ ব্র্যান্ড। উত্তাপ ছড়িয়ে তিনি চলতি বছরের সেরা পারফর্মারদের একজন। ২০২১ সালে পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টিতে সর্বাধিক রান করা ব্যাটসম্যান। পিএসএলে মুলতান সুলতানকে জিতিয়েছেন শিরোপা, ব্যাটে হাতে দলের হয়ে এবারের আসরে সর্বোচ্চ ৫০০ রান সংগ্রাহক।
আলোচনায় তাই বরাবরাই তার নাম উঠে আসে। না চাইলেও উঠে আসে বলা চলে। চেপে রাখার দিন শেষ। সমালোচনা চলবে হয়তো এরপরেও। কারণ, সমালোচনা না থাকলে কেউ পরিপক্ব হতে পারেনা। জবাব দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়না। আগন্তুক থেকে আর স্থায়ী হওয়ার উপলক্ষ আসেনা। ব্যর্থতার গল্প মুছে নতুন করে সফলতার গল্প উপস্থাপন করা সম্ভব হয়না।
দল হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে শীর্ষস্থানটা এখন ইংলিশদের। একসময় যে স্থান ছিলো পাকিস্তানের। বর্তমানে পাকিস্তান এই ফরম্যাটে চারে আর একসময়ে এই ফরম্যাটের ব্যাটসম্যানদের শীর্ষস্থান ধরে রাখা বাবর আজম একধাপ নীচে নামলেও, রিজওয়ানকে নিয়ে প্রতিপক্ষের উপর চড়াই হওয়ার রেশ চলছে দেদরসে। সবশেষ ইংলিশদের বিপক্ষে দুজনের ১৫০ রানের উদ্বোধনী জুটিতে ঘরের মাঠেই টালমাটাল ইংলিশরা। ব্যাট হাতে লিয়াম লিভিংস্টোনের শতকে বেশ ভালো জবাব দিতে থাকলেও দিনশেষে তা আর কাজে দেয়নি।
বাবরের মত বড় তারকার ছায়ায় থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও রিজওয়ান নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। পাচ্ছেন বাবরের পূর্ণ সহায়তা। যে টি-টোয়েন্টিতে ছিলেন একজন আগন্তুক! সেই টি-টোয়েন্টিতেই স্থায়ী হয়ে তার ব্যাট রূপ নিয়েছে তলোয়ারে। আড়ালে থাকার দিন হয়তো এবার ফুরিয়ে গেছে।
বাইশ গজে দ্যুতি ছড়াবেন বিদ্যুৎ গতিতে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যে আর বেশি দূরে নেই। বাবরের উপর সবার নজর থাকলেও রিজয়ানই সম্ভবত সবচেয়ে বড় তুরুপের তাস হতে যাচ্ছে পাকিস্তানের জন্য। তাই পাকিস্তান আর রিজওয়ানের চেয়ে অধীর আগ্রহে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য আর কেই বা অপেক্ষা করছে?