স্যামি, আপনি জোকার নন

বলছি ২০১২ সালের কথা।

তখন ডিসেম্বর মাস। এক কালের প্রতাপশালী দলটা তার জৌলুস হারিয়েছে অনেক দিন হল। জীর্ন সেই দলটাকে এবার হারালো মুশফিকুর রহিমের বাংলাদেশ। খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে পরপর দুই ওয়ানডেতে অসহায় আত্মসমর্পনের পর সদ্য তখন ঢাকায় এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ; এক কালের মহাদানবীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

সেই ডিসেম্বরের শীতেই কুয়াশার ফাঁক গলে প্রথম দেখেছিলাম ড্যারেন স্যামিকে। স্থান মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অ্যাকাডেমি মাঠ। তখন আমার তো বটেই তাকে ঘিরে ক্রিকেট বিশ্বের কারোই বাড়তি আগ্রহ থাকার কোন কারণ ছিল না। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতেই তাকে দেখা হত তাকে। ক’দিন আগেই জিতে আসা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপাটাও তখন ‘ফ্লুক’ মনে হত। আমিও এই ‘ফ্লুক ভাবা’দের দলে ছিলাম।

শ্রদ্ধা তো দূরের কথা, ‘জোকার’ সুলভ আচরণটা দেখে বরং একটু বিরক্তই লাগতো। ঢাকায় সেবার অনেক লড়াই করে ২-২ সমতা আনলেন বটে। কিন্তু, সিরিজ জেতাতে পারলেন না দলকে। বাংলাদেশ ৩-২ ব্যবধানে জিতে সিরিজ নিজেদের পকেটে ভরে নিলো। সিরিজের শেষ সংবাদ সম্মেলনে স্বভাবসুলভ হাসিমুখেই এসেছিলেন। গোটা সংবাদ সম্মেলনেই ছোট খাটো খুনসুটি করলেন এর-ওর সাথে। আমরা মনে মনে আবারও তাঁকে ‘জোকার’ বললাম।

তবে শেষটা করলেন একেবারেই অন্য ভাবে। সবার প্রশ্নের জবাব দেয়ার পর মাইকটা কাছে নিয়ে বললেন, ‘জেন্টলমেন, আমাকে এক মিনিট সময় দেবে!’ আমরা থেমে গেলাম। এরপর তিনি যা বলা শুরু করলেন তাতে স্রেফ স্তব্ধ হয়ে গেলাম – ‘ক্রিকেটার হিসেবে আমি আহামরি কেউ নই। অধিনায়ক হিসেবেও কেমন সেটা তো তোমরা দেখতেই পাচ্ছ। জানি মাঠের বাইরেও আমাকে নিয়ে অনেক কথা হয়; তোমরাও আমাকে নিয়ে মজা কর। শুধু একটা কথা তোমাদের কাছে জানতে চাই, আমি কি তোমাদের যথেষ্ট বিনোদন দিতে পেরেছি?’

আমাদের কারও মুখে কোনো কথা নেই। চোখে শুধু রাজ্যের বিস্ময়। আসলেই কি সামনে বসে একটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের অধিনায়ক! ছলছল চোখে তিনি বের হয়ে গেলেন। আমি মুগ্ধ হলাম।

এবার বলি ২০১৪ সালের কথা। দ্বিতীয় দফায় ড্যারেন স্যামিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। এবার মঞ্চটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের; সেই মিরপুরেই। এবার দেখলাম অনিন্দ্য সুন্দর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের অনন্য ‘গ্যাংনাম’ নাচ!

দলকে সেমিফাইনালে উঠিয়ে দিয়ে ড্যারেন স্যামি তো রীতিমত প্যাড পরেই চলে আসলেন সংবাদ সম্মেলন কক্ষে। এবার আর পিনপতন নীরবতা নয়; বিষম খাওয়ার মত হাসিয়ে গেলেন স্যামি। আর বলে গেলেন, ‘মাথা বা টেকনিক বা জীবন দিয়ে নয়, আমরা খেলাটা শুধুই আনন্দ করার জন্য খেলি। ক্রিকেট ইজ নট মোর দ্যান লাইফ!’ সত্যিই তো। আমি আবারও মুগ্ধ হলাম!

এখন সাল ২০১৬। তিন এপ্রিল রাতে আবারও মুগ্ধ হলাম। আবারও দেখলাম সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। দেখলাম, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অধিনায়ককে। বুঝলাম, গোটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টুর্নামেন্টে যিনি মাত্র ১৪ বলে মোটে আট রান আর তিন ওভার বোলিং করেছেন তিনিই আজ ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে নন্দিত মানুষ।

কারণ, এই তিনিই যে টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে দুটো বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছেন। আপনি অন্তত এই ঘোরতর অন্ধকারে থাকা মানুষগুলোকে এটুকু বোঝাতে পেরেছেন – ক্রিকেট আর যাই হোক, জীবন দিয়ে খেলার বস্তু নয়; ক্রিকেট খেলতে হয় মনের আনন্দে। আপনিই তো শিখিয়ে দিয়েছেন, চাপ বলতে কিছু নেই; সব ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’।

তা না হলে বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ ওভারে পর পর চারটা ছক্কা মারা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। স্যামি, আপনি আর যাই হোন না কেন; জোকার নন! আপনাকে নিয়ে ভাবনাটা ভুল ছিল। মাফ করবেন, স্যামি! আপনার মত কাউকে ক্রিকেট বিশ্ব আগে কখনও দেখেনি, ভবিষ্যতেও দেখবে কি না সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link