প্রথাগত নাম্বার টেন, স্বর্ণালী কৌশল আজ বিলুপ্তির পথে

ফুটবল সময়ের সাথে হচ্ছে পরিবর্তন। ফলে প্রথাগত নম্বর দশ এক কথায় বিলুপ্তির পথে। এমন এক যুগে ম্যারাডোনা, জিদানের মতো আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডাররা থাকলে কিভাবে খেলতেন? প্রশ্নটা সবার জন্য উন্মুক্ত।

পছন্দের জার্সি নাম্বার কি? বেশিভাগের উত্তরই হবে ১০ নম্বর। হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাঁরা যে কাকা, জিনেদিন জিদান, মিশেল প্লাতিনি, নেইমার, লিওনেল মেসি বা মেসুত ওজিল কে দেখে বড় হওয়া প্রজন্ম। কিন্তু মজার কথা কি জানেন? আজকালকার প্রজন্মের ফুটবলে নম্বর ১০ কেবলই মাত্র একটা জার্সি। আদতেই তাই। আধুনিক ফুটবল থেকে প্রথাগত নম্বর দশ বা কেন্দ্রীয় আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডার পজিশন এখন বিলুপ্তির পথে।

ফুটবল একটা সময় কেন্দ্রীয় আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডকে ঘিরে খেলা হত। মোক্ষম উদাহরণ আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। এর আগে ছিলেন হুয়ান রোমান বা রিকেলমে, পাবলো  আইমারের মতো প্রজন্ম খ্যাত সব নম্বর ১০। এর পর তাদের দেখানো পথেই সবশেষ আসেন জীবন্ত কিংবদন্তি লিওনেল মেসি। যারা প্রত্যেকেই দলের মধ্যমণি।

ব্রাজিল দলের বেলাতেও ছিলেন কাকা, রোনালদিনহোর মতো প্রথাগত আক্রমনধর্মী সব মিডফিল্ডার। ইউরোপেও এই ধারা বজায়ে ছিল জিদান, প্লাতিনি বা ওজিলদের হাত ধরে। অবস্থানটা জার্মান দের কাছে এতটাই দরকারি মনে হয়েছিল। তাঁরা বলত ‘স্পিলমেখার’ বা মূল খেলোয়াড়। এ পজিশনে খেলোয়াড় দের হতে হতো বিচক্ষণ, সুদক্ষ এবং সবচেয়ে দরকারীভাবে সৃজনশীল। কিন্তু কেন এই পজিশনের এতটা গুরুতর ছিল?

কারণ, মূলত ফরমেশন বা দল সাজানোর পদ্ধতি। সে সময়ে ম্যানেজারেরা ৪-৪-১-১,৪-৪-২ কিংবা ৪-২-৩-১ পদ্ধতিতে দল সাজাতেন। ফলে আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডের দায়িত্ব থাকতো মধ্য মাঠ থেকে সমন্বয় সাধনের। যার জের ধরে আক্রমন ভাগ গোল করতো। তবে ধীরে ধীরে এই অবস্থা বদলেছে।

বিশেষ করে গত দু দশকে এই ফরমেশন ছেড়ে এসেছেন বহু ম্যানেজার। লা লিগা, প্রিমিয়ার লিগ, বুন্দেসলিগা বা সিরি আ-তে ১৪-১৮ সালের মাঝে  প্রথাগত নম্বর ১০ এর ব্যাবহার কমেছে যথাক্রমে ৬৪%,৩৯%,২৮% এবং ২%। এর কারণ ছিল টোটাল ফূটবল এবং পুরো মাঠে সাম্য রক্ষায় কাজ করা।

এ সময়ে বহুল পরিচিত ফরমেশন ৪-৩-৩। যেখানে মধ্যমাঠে তিনজন করে খেলোয়াড় রক্ষনভাগ এবং আক্রমণ ভাগের মাঝে সাম্য রক্ষা করেন। পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনা যুগের টিকিটাকার কথা আসবেই এখানে। জাভি, ইনিয়েস্তা আর বুস্কেটসের ধারাবাহিক পাসিং করে এগিয়ে আক্রমনভাগেকে বল দেয়া ছিল একা যুগান্তকারী ঘটনা।

তবে, এর বাইরেও নম্বর ১০ এর কিছু বিকল্প এসেছে বাজারে। এক সময়ে কুখ্যাত ছিল ছয় নম্বর জার্সির রক্ষণশীল মিডফিল্ড। এখন অন্যতম সমাধানের নাম। এজন্য অনেক খেলোয়াড় হারিয়েও যান।বিখ্যাত আর্সেনাল তারকা ওজিল তাঁর এক জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তখনকার ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার ওজিল কে সৃজনশীল খেলোয়াড় হিসেবে দেখলেও অভাব দেখেন রক্ষণশীলতার।

সেই সময় থেকেই সব ম্যানেজারই কিছুটা রক্ষনশীল মিডফিল্ডারের দিকে ঝুকে পড়েন। উদাহরণ দিলে এখনকার ম্যানসিটির রদ্রির বা আর্জেন্টাইন ডি পলের কথাই চলে আসে। এই পজিশনের খেলোয়াড়রা রক্ষণ এবং মধ্যমাঠ থেকে সমন্বয়ের বাইরে এসে বিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টিতে ব্যাপক কাজে দেয়। মাঝ মাঠে অতিমানবিক ওয়ার্ক রেট তাদের বিশেষ গুণ।

ডিফেন্সিভের যুগে আরও এক ধারার মিডফিল্ডও আসে ফুটবল পাড়ায়। আনচেলত্তি আন্দ্রিয়া পিরলোর মতো নান্দনিক এক খেলোয়াড়কে নামিয়ে করেন হোল্ডিং মিড। কড়া সমালোচনার বিপরীতে যাওয়া এ সিদ্ধান্তের ফল ছিল বিশ্ব ফুটবলের নন্দিত কিংবদন্তি ডিপ লায়িং প্লে মেকার আন্দ্রিয়া পিরলো।

এই ছয় নম্বরের বাইরেও চার বা পাঁচ নম্বর পজিশনে খেলা জোশুয়া কিমিখ বা বার্সেলোনার ডি জং এর চমৎকার নিদর্শন। সাবেক বিশ্বকাপজয়ী জার্মান কোচ জোয়াকিম লো মনে করেন একজন নম্বর ১০ এর জায়গায় ৪, ৫ কিংবা নম্বর ৬ খেলাকে আরও বৈচিত্র দেয়। আক্রমণ নির্মানে সাহায্য করে। সাথে প্রতিপক্ষের খেলায় চাপ তৈরি করে।

তবে আধুনিক ফুটবলে এখনও কিছু  প্লে মেকার মিডফিল্ডার ছড়াচ্ছেন আলো। ম্যানচেস্টার সিটির কেভিন ডি ব্রুইনা বা রিয়াল মাদ্রিদের লুকা মদ্রিচের কথাই ধরেন। তাঁরা  পাসিং এর পাশাপাশি রক্ষণেও সচল। একসাথে মাঠে দরকারের সাপেক্ষে ওঠা নামাতে তাদের জুড়ি নেই। তবে, বর্তমানে সব থেকে এগোনো মিডফিল্ডার বায়ার্নের জার্মান তারকা থমাস মুলার।

২৩ সালের বায়ার্ন দলে তিনি মাঝ মাঠ মাতান নিজের আগ্রাসী খেলা দিয়ে। দু’জন কিছুটা ডিপ লায়িং মিডের সামনে দরকারের সাপেক্ষে উইং এর সহায়ক হিসেবে এগুতেন। আক্রমণ ভাগের মাঝেই বল কে আটকে রাখতে সাহায্য করতেন। আক্রমনকেই সেরা রক্ষণকৌশল বানান তিনি।

ফুটবল সময়ের সাথে হচ্ছে পরিবর্তন। ফলে প্রথাগত নম্বর দশ এক কথায় বিলুপ্তির পথে। এমন এক যুগে ম্যারাডোনা, জিদানের মতো আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডাররা থাকলে কিভাবে খেলতেন? প্রশ্নটা সবার জন্য উন্মুক্ত।

Share via
Copy link