১৯৯৪ বিশ্বকাপের সেই বিখ্যাত ফাইনালের চূড়ান্ত পেনাল্টি মিস করার পরে বহু ভারতীয় সমর্থকেরও নয়নের মনি পনিটেল সজ্জিত সুদর্শন রবার্তো বাজ্জিও নিজের দেশে তো বটেই, সমর্থকদের মধ্যেও রাতারাতি খলনায়ক বনে গিয়েছিলেন।
একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম যেখানে বাজ্জিওর বিশ্বকাপ পরবর্তী মানসিক অবসাদ, লড়াই এবং ফিরে এসে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ খেলার বর্ণনা আছে; কিভাবে তিনি ঘুমের মধ্যেও দু:স্বপ্ন দেখতেন যে পেনাল্টি নেবার পর বলটা বারের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। এই সময়ে তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর স্ত্রী, যিনি সবসময় উৎসাহ দিয়ে বাজ্জিওকে ফিরে আসতে সাহায্য করেছিলেন।
আমরা সবাই জানি, ৯৮ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে বাজ্জিওর ইতালি যখন চিলির জামোরানো সালাস জুটির কাছে আচমকাই ২ গোল খেয়ে ১-২ গোলে পিছিয়ে, আর প্রথম ম্যাচেই হারের মুখ দেখে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে যাবার আশংকায় ভুগছে, তখনই ম্যাচ শেষের মাত্র মিনিট পাঁচেক আগে পেনাল্টি পায় ইতালি। বাজ্জিওর অতি বড় সমর্থক ও কি ভেবেছিলেন যে ৯৪ বিশ্বকাপের দুঃস্বপ্নের পর বাজ্জিওই আবার পেনাল্টি কিক টা নেবেন?
কিন্তু তিনি, নিজের এবং গোটা দেশের শাপমুক্তির জন্য এগিয়ে এসে পেনাল্টি টা নিয়েছিলেন এবং গোলকিপার কে বোকা বানিয়ে গড়ানে শটে গোল করে মুখে আঙ্গুল দিয়ে গোটা স্টেডিয়াম কে চুপ করতে বলেছিলেন। যেন তিনি বলতে চাইছিলেন, একটা পেনাল্টি মিস করলেই কেউ খারাপ ফুটবলার হয়ে যায় না, আর ৯৪ এর মিস পেনাল্টির ঠিক বিপরীতধর্মী একটা শটে গোল করে হয়তো সেদিনের ভুলের প্রায়শ্চিত্তও করেছিলেন বাজ্জিও।
এই ঘটনাটা চোখের সামনে দেখা, কিন্তু ৯৮ বিশ্বকাপেই ঘটেছিলো এরকমই আরেকটা ঘটনা, যার কথা আজকে বলবো। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসের যুযুধান দুই দল, যাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু সেই ৮৬ বিশ্বকাপে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আর্জেন্টিনা আর ইংল্যান্ড।
ইংল্যান্ড বলতেই যেটা মাথায় আসে, যে দেশীয় মিডিয়ার অস্বাভাবিক প্রচার এবং প্রশংসা সত্ত্বেও, প্রায় কোনো খেলাতেই নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি তারা। ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিততে তাদের সময় লেগেছে ৪৪ টা বছর, এবং সেটাও সরাসরি জয়ের মাধ্যমে অর্জন করতে পারেনি ইংল্যান্ড।
ফুটবলের একমাত্র বিশ্বকাপ ইংল্যান্ড জিতেছিল ১৯৬৬ সালে, ঘরের মাঠে, এবং কিভাবে, সেটা নিয়ে বহু বিতর্ক আছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো জিওফ হার্স্টের শট গোললাইন না পেরোনো সত্ত্বেও গোল দেওয়া এবং ৪-২ ফলে ফাইনাল জিতে জার্মানি কে হারিয়ে ইংল্যান্ডের একমাত্র কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জেতা।
দল হিসেবে সাফল্য সেভাবে না পেলেও, ইংল্যান্ড আমাদের উপহার দিয়েছে অনেক আকর্ষণীয় ফুটবলারদের, আশি-নব্বই এর দশকে গ্যারি লিনেকার, পল গ্যাসকোয়েন, অ্যালেন শিয়ারার কে নিয়ে মাতামাতির পর দর্শকরা পেলেন গত কয়েক দশকের ইংল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার, ডেভিড বেকহ্যামকে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে শুরুর দিকেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন বেকহ্যাম, ফ্রীকিক, দূরপাল্লার শট এ গোল করা, সেটপিস মুভমেন্ট ইত্যাদি তে অসাধারণ দক্ষতার জন্য অল্পদিনেই পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। ৯৪ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড কোয়ালিফাই করতে না পারায়, বেকহ্যামের সামনে প্রথম বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ আসে ৯৮ সালে। প্রথমেই ধাক্কা আসে কোচের দিক থেকে।
কোচ গ্লেন হডল প্রকাশ্যেই বেকহ্যামের প্রতি অভিযোগ তোলেন যে তিনি ক্লাব ফুটবলকে বেশি গুরুত্ব দেন, এবং বিশ্বকাপে পর্যাপ্ত মনোযোগ দিচ্ছেন না। এর পরে প্রথম দুটো গ্রুপ লিগের খেলায় তিনি সুযোগ পান না। অবশেষে গ্রূপের শেষ ম্যাচে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে দলে রাখা হয় তাঁকে, এবং সুযোগ পেয়েই ৩০ গজ দূর থেকে বাঁকানো ফ্রীকিক থেকে গোল করে ইংল্যান্ডকে ২-০ গোলে জিততে সাহায্য করেন তিনি। দ্বিতীয় রাউন্ডের অর্থাৎ শেষ ষোলোর খেলায় মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনা।
এখানে আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ড এর রেষারেষির সূত্রপাতের ঘটনাটা একটু বলা দরকার। ১৯৬৬ সালের বিতর্কিত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। এই ম্যাচটাকে আর্জেন্টিনার দেশবাসী ‘শতাব্দীর সেরা চুরি’ আখ্যা দিয়েছেন।
জিওফ হার্স্টের গোলে ইংল্যান্ড ১-০ জিতলেও, আর্জেন্টিনা দাবি করে হার্স্ট পরিষ্কার অফসাইডে ছিলেন। গোটা টুর্নামেন্টেই রেফারিং এর মান ছিল অত্যন্ত নিম্ন। এ ছাড়াও বহু পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের অভিযোগ ও উঠেছিল ইংল্যান্ড এর আয়োজকদের প্রতি, তার মধ্যে অন্যতম হলো আর্জেন্টিনার প্র্যাক্টিস মাঠে কোনো গোলপোস্টই না থাকা!
এরপরে আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয় ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। এর ঠিক ৪ বছর আগে হয় গ্রেট ব্রিটেন এর সাথে আর্জেন্টিনা রিপাবলিক এর কুখ্যাত ফকল্যান্ডের যুদ্ধ। অধিকাংশ আর্জেন্টিনা সমর্থক এবং খেলোয়াড়রাও এই ম্যাচটিকে ফকল্যান্ড যুদ্ধের বদলা হিসেবে দেখছিলেন। এই ম্যাচে ম্যারাডোনা করেন একইসাথে ইতিহাসের সবথেকে বিতর্কিত ও সবথেকে বিখ্যাত দুটি গোল, মাত্র ৪ মিনিটের ব্যবধানে।
প্রথম গোলটি হ্যান্ড অফ গড নামে খ্যাত, যেটি ম্যারাডোনা হাত দিয়ে করেছেন বলে পরে নিজেই স্বীকার করেন, কিন্তু রেফারি সেটা বুঝতে পারেন নি। দ্বিতীয় গোলটি মাঝমাঠ থেকে ৬ জন ইংলিশ মিডফিল্ডার ও ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে একার কৃতিত্বে করা গোল, যেটা ২০০২ সালে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা গোল নির্বাচিত হয়। অনেকে এই গোলটিকে বিংশ শতাব্দীর সেরা গোল, মতান্তরে সর্বকালের সেরা গোল ও বলে থাকেন।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা ২-০ এগিয়ে দেবার পরে শেষের দিকে লিনেকার ২-১ করলেও ইংল্যান্ডের হার আটকায়নি। ম্যারাডোনা নিজে পরে ইন্টারভিউ তে বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল আমরা যেন একটা ফুটবল টিমকে না, গোটা ইংল্যান্ড দেশটাকেই হারালাম। যদিও ফকল্যান্ড যুদ্ধের সাথে ফুটবল ম্যাচের কোনো সম্পর্ক নেই, তবুও আমরা জানি কত আর্জেন্টিনার যুবকদের ওরা মেরেছিলো ফকল্যান্ড যুদ্ধে, যেন বন্দুক দিয়ে পাখি মারছে, এমনভাবে!! তাই এই ম্যাচ ছিল বদলার ম্যাচ!’
এর পরে দুটি গোলের মধ্যে কোনটি তার বেশি প্রিয় জিজ্ঞেস করায় ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় প্রথম গোলটিই আমার কাছে একটু বেশি প্রিয়, যদিও ওটা হাত দিয়ে করা। কেননা এটা অনেকটা চোরের উপরে বাটপাড়ি করার মত!’
বোঝাই যাচ্ছে তিনি ৬৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের চুরি করে জেতার কথা বলতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ড মিডিয়া ও সমর্থকরা এই ম্যাচটিকে অন্যায়ভাবে তাঁদের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেওয়ার ম্যাচ বলেই চিহ্নিত করেন। এই ম্যাচটির পর থেকেই ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার রেষারেষি চূড়ান্ত আকার ধারণ করে, যদিও পরের বার তারা বিশ্বকাপে মুখোমুখি হয় আবার ১২ বছর বাদে, ৯৮ এ।
৯৮ সালের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে দু দলেই ছিলেন বেশ কয়েকজন ভালো স্ট্রাইকার। ইংল্যান্ডে বর্ষীয়ান অ্যালেন শিয়ারার যেমন ছিলেন, অষ্টাদশী মাইকেল ওয়েনও ছিলেন। ছিলেন পল স্কোলস, বেকহ্যাম এবং কীপার ছিলেন ডেভিড সিমেন। অন্যদিকে আর্জেন্টিনায় ছিলেন বাতিস্তুতা, জানেত্তি, ভেরন, ক্রেসপো, আয়ালা রা। ম্যাচের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই দুই দলই পেনাল্টি পায়; বাতিস্তুতা এবং শিয়ারার পেনাল্টি থেকে গোল করে ম্যাচের ফল ১-১ বজায় রাখেন।
এরপরে প্রথম বিশ্বকাপ খেলা প্রায় বালক মাইকেল ওয়েন করেন ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোল, প্রায় একার চেষ্টায় দুজনকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে রানিং বলে শট মেরে লেফট কর্নারে জালে জড়িয়ে দেন বল। ৪৫ মিনিটে আবার সমতা ফেরান জানেত্তি, ফ্রি-কিক থেকে ফাঁকায় বল পেয়ে। ম্যাচের ৪৭ তম মিনিটে ঘটে কুখ্যাত ঘটনাটি। বেকহ্যামকে মাঝমাঠে বেশ খারাপভাবে ফাউল করেন ডিয়েগো সিমিওনে।
বেকহ্যাম যখন পড়ে কাতরাচ্ছেন, তখন ওঠার সময় বেকহ্যামের মাথার পেছনদিকে আবার হাত দিয়ে চাপড় মারেন সিমিওনে। বেকহ্যাম প্রায় না দেখেই শুয়ে থাকা অবস্থায় ডান পা হঠাৎ ভাঁজ করে সিমিওনের হাঁটুর পেছনদিকে আঘাত করেন এবং সিমিওনে পড়ে যান। রেফারি খুব কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন, উনি সিমিওনেকে হলুদ এবং বেকহ্যামকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।
এরপরে কোনো দল কোনো গোল করতে পারেনি, যদিও সোল ক্যাম্পবেল এর একটি গোল এলান শিয়ারারের ফাউলের জন্য বাতিল করা হয়। টাইব্রেকার এবং ইংল্যান্ডের সম্পর্ক খুবই মধুর, তা ফুটবলপ্রেমী মাত্রই জানেন। পেনাল্টিতে ইংল্যান্ড ৪-৩ ফলে হেরে যায়। বেকহামের মতো পেনাল্টি ও ফ্রি কিক বিশেষজ্ঞ মাঠে না থাকায় এবং প্রায় ৭৫ মিনিট ( অতিরিক্ত সময় ধরে) দশজনে খেলতে হওয়ায় ইংল্যান্ডের জেতার যেটুকু আশা ছিল সেটুকুও ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
বেকহ্যাম এক নিমেষে হিরো থেকে ভিলেনে পরিণত হন, ঠিক রবার্তো বাজ্জিওর ৪ বছর আগেকার মত। দা ডেইলি মিরর হেডলাইন করে – ‘টেন হিরোইক লায়ন্স অ্যান্ড আ স্টুপিড বয়’; বলাই বাহুল্য স্টুপিড বয় কাকে বলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে দিয়েগো সিমিওনে স্বীকার করেন যে তিনি বেকহ্যামের পা চালানোর ফলে আহত হবার নাটক করে পড়ে যান যাতে বেকহ্যাম লাল কার্ড দেখেন। আর্জেন্টিনা দলের বাকিরাও রেফারিকে আবেদন করেন বেকহ্যাম কে লাল কার্ড দেখানোর জন্য।
‘স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড’ আর্জেন্টিনার কড়া সমালোচনা করে লেখে – ‘সিমিওনে বেকহ্যামকে কড়া ফাউল করে নিজে একটা ইটের স্তুপের মতো মাটিতে পড়ে যায়, বেকহ্যাম কে লাল কার্ড দেখানোর জন্য, যে ট্যাক্টিক্স তারা পরের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে নেদারল্যান্ডের সঙ্গেও নিয়েছিল এবং একজন ডাচ প্লেয়ার কে লাল কার্ড দেখতে বাধ্য করেছিল।’
যদিও আর্জেন্টিনা নেদারল্যান্ডের কাছে বার্গক্যাম্পের জয়সূচক গোলে ২-১ ব্যবধানে হারে এবং বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যায়। আর্জেন্টিনার ওরিয়েল ওর্তেগাও লাল কার্ড দেখেন। অন্যান্য ব্রিটিশ সাংবাদিকরাও পরবর্তীকালে সিমিওনের সমালোচনা করে বলেন যে তিনি এমনভাবে পড়ে গিয়েছিলেন যেন কেউ তাকে গুলি করেছে!! যেন তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন! এমনই ছিল তার অভিনয়!
এর পরেই বেকহ্যামের জীবন রাতারাতি পাল্টে যায়। তিনি পাবলিক এনিমি নম্বর ১ হয়ে ওঠেন ব্রিটিশদের কাছে। এমন কি খুনের হুমকিও দেওয়া হয় তাকে। প্রায় প্রত্যেকটি সংবাদপত্রেই বেকহ্যামকে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ স্বপ্ন চুরমার করে দেবার জন্য দায়ী করা হয়। বেকহ্যাম খেলা চালিয়ে গেলেও, দর্শকদের বিদ্রুপের শিকার হতে থাকেন। ২০০০ ইউরো কাপে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বীতশ্রদ্ধ বেকহ্যাম মধ্যম আঙ্গুল প্রদর্শন করে আরো বিতর্কের মুখে পড়েন।
বেকহ্যামের লড়াইটা সহজ ছিলো না। দর্শকদের বিদ্রুপের শিকার হতে হতেও তিনি নিজেকে হেরে যেতে দেননি। অবশেষে ২০০২ বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে গ্রিসের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত ফ্রিকিক থেকে জয় এনে দিয়ে ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করান তিনি। আস্তে আস্তে দর্শক ও ফ্যানদের সমর্থন ফিরতে থাকে তাঁর দিকে।
নিয়তির লিখন যদি কিছু থাকে, তার ফলেই হয়তো, ২০০২ বিশ্বকাপে একই গ্রুপে পড়লো ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনা। আগের দুটি বিশ্বকাপে যেখানে দু দল মুখোমুখি হয়েছে, দুবারেই আর্জেন্টিনার হাতে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ব্রিটিশদের। দুবারেই বিতর্কিতভাবে, একবার ম্যারাডোনা হ্যান্ড অফ গড, আরেকবার বিতর্কিত লালকার্ড। তাই ইংল্যান্ড শিবিরে উত্তেজনা এবং চাপ – দুইই ছিল।
এর উপরে আবার প্রথম ম্যাচ সুইডেন এর সাথে ড্র করে ইংল্যান্ড আরো চাপে পড়ে যায়, কেননা গ্রুপ স্টেজ থেকে পরের রাউন্ডে যেতে হলে আর্জেন্টিনা ম্যাচে জয় দরকার, নইলে শেষ ম্যাচে অনেক হিসেব কষতে হবে। এই ম্যাচে প্রথম থেকেই সংঘর্ষপূর্ণ হলেও গোল তেমন হয়নি। কিন্তু ভাগ্য এদিন বেকহ্যামের সঙ্গে ছিল। যে ভাগ্য তাঁকে চার বছর আগে ঠেলে দিয়েছিলো সমালোচনা এবং বিদ্রুপের অতলে, সেই ভাগ্য এবার তাকে ফিরিয়ে দিলো সব হৃত সম্মান।
ম্যাচের হাফ টাইমের ঠিক আগে মাইকেল ওয়েন কে বক্সের মধ্যে ফাউল করেন মাওরিসিও পচেত্তিনো। রেফারি পেনাল্টি দেন। পেনাল্টি নিতে, এবং নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পেনাল্টি নিতে আসেন ডেভিড বেকহ্যাম, তিনি এখন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ও বটে। গোলকিপার এর ঠিক বাঁদিক দিয়ে মাটি ঘেঁষা জোরালো শটে গোল করেন বেকহ্যাম। আশ্চর্যজনক হলো, বেকহ্যামের শটের লক্ষ্য গোলপোস্টের একদম উপরের কোনায় বা পোস্ট ঘেঁষে ছিলোনা।
গোলরক্ষক পাবলো কাভালেরো অনায়াসে আটকে দিতে পারতেন যদি তিনি সঠিক দিকে ঝাঁপাতেন; তার বদলে তিনি উল্টো দিকে বডি মুভমেন্ট করে বসায় বেকহ্যামের শট আটকানোর কোনো সুযোগ ছিলো না তার কাছে। এই গোলের পরে অশ্রুসজল চোখে বেকহ্যামের নিজের জার্সির বুকে ইংল্যান্ডের ফুটবল টিমের লোগো ধরে দর্শকদের দিকে ঝাঁকিয়ে দলের বাকিদের সাথে উল্লাস করা বুঝিয়ে দিয়েছিলো, গত চার বছর কি অপরিসীম চাপের মধ্যে তিনি ছিলেন, এবং আজ সেই চাপ থেকে শাপমুক্তি ঘটলো তাঁর।
এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত, গোটা ম্যাচে আর কোনো গোল হয়নি, এবং শেষের দিকে আর্জেন্টিনা বারবার আক্রমণ করে চাপ বাড়ালেও ইংল্যান্ড তাদের লিড ধরে রেখে ম্যাচ জিততে সক্ষম হয়, এবং একইসাথে বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম ফেভারিট আর্জেন্টিনা এই ম্যাচ হারার আফটারশক বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, পরের ম্যাচে সুইডেনের সাথে ড্র করে গ্রূপ স্টেজ থেকেই ছিটকে যায়।
আর্জেন্টিনার গ্রুপ থেকেই বিদায় ফুটবল বিশ্বে, বিশেষত ব্রিটিশ মিডিয়ার কাছে ৮৬ এবং ৯৮ এর ‘জোচ্চুরি’ করে জেতার বদলা হিসেবেই বন্দিত হয়ে থাকে। যদিও ইংল্যান্ড এই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে পড়ে সেবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের সামনে, এবং রোনালদিনহোর ম্যাজিক ফ্রি-কিকের ফলে ২-১ হেরে বিদায় নেয়, কিন্তু বেকহ্যাম নিজেকে আবার তুলে আনেন খ্যাতির মধ্যগগনে এবং পরবর্তীকালে ক্লাব ফুটবলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়েল মাদ্রিদের হয়ে দাঁপিয়ে খেলেন।
২০১৬ সালে জিকিউ ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক ইন্টারভিউ তে বেকহ্যাম বলেন তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা পাঁচটি মুহূর্ত বাছাই করতে বসলে তিনি ৯৮ সালের লাল কার্ড দেখার ঘটনাকে তার মধ্যে রাখবেন। সাংবাদিকের অবাক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই লাল কার্ড তাকে আরো পরিণত এবং উন্নত ফুটবলার হতে সাহায্য করেছে। দেশের হয়ে তাঁর অর্জন খুব বড় কিছু না হলেও, ক্লাব ফুটবলে তিনি অনেক কিছু অর্জন করেছেন।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এর হয়ে তিনি জিতেছেন ছয়টি প্রিমিয়ার লিগ, দু’টি এফ.এ কাপ, একটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ এবং একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। পরবর্তীকালে তিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে স্প্যানিশ লিগ ও সুপার কাপ জেতেন। মার্কিন ক্লাব লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যালাক্সির হয়ে দুবার লিগও জিতেছেন তিনি। ক্যারিয়ারের শেষলগ্নে তিনি প্যারিস সাজা র হয়ে ফ্রেঞ্চ লিগও জেতেন এবং অবসর নেন।
সুদর্শন এই খেলোয়াড় মাঠে এবং মাঠের বাইরেও ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাঁর সেলিব্রিটি স্ত্রী ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম ও তিনি থাকতেন ফ্যাশন, স্টাইল এবং রুপোলি পর্দার স্পটলাইটে। আর এ সবের শুরুই হয়তো হয়েছিল, সেই একটা লাল কার্ড থেকে!