রায় রাজত্ব

ভারতের ক্রিকেটে বাংলার সাহসী ছেলে সৌরভদের যুগ তখনো আসেনি। আসলে সৌরভদের জন্মেরও অনেক বছর আগের কথা। কলকাতার কুমোরতলীতে বড় হওয়া একটা ছেলে তাঁর সময়ে ভারতের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। যেই সময়ে ভারতের ব্যাটসম্যানরা স্পিনটাই ঠিকমত খেলতে পারতো না সেই সময়ে দুনিয়ার নামী সব পেসারদের ও শাসন করেছেন এই বঙ্গ সন্তান।

সৌরভ গাঙ্গুলিরা পরবর্তীকালে বলেছেন তারা যখন কলকাতায় খেলা শুরু করেছেন তখন তাঁদের সামনে বাংলা থেকে এমন কেও ছিলেন না যাকে অনুসরণ করা যায়। তবে তারা কলকাতার মাঠে ঘাটে একজনের নাম শুনেই বড় হয়েছেন। তিনি হলেন ‘পঙ্কজ দা’, মানে পঙ্কজ রায়। সৌরভরাও তখন পঙ্কজ দা’র মতই হতে চাইতেন।

পঙ্কজ রায় বাংলার ক্রিকেটের প্রথম মেগা স্টার। প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার যিনি ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন। যিনি ১৯৫১-৬০ পুরো এক দশক ভারত ক্রিকেটের সেরা ওপেনার ছিলেন। বলা হয়, সুনীল গাভাস্কাররা ভারত ক্রিকেটের ব্যাটসম্যানশিপের সংজ্ঞা বদলে দেয়ার আগের সময়টাতে পঙ্কজ ছিলেন দেশটার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে তাঁর পূর্বপুরুষরা নামকড়া জমিদার ছিলেন। বলা যায় এই অঞ্চলে রায় দের রাজত্ব চলতো। পরবর্তীকালে পঙ্কজ রায় রাজত্ব করেছেন বাংলার ক্রিকেটে, ভারতের ক্রিকেটে সর্বপরি বিশ্বক্রিকেটে।

পঙ্কজ রায়কে দেখলে আপনার কখনো একজন ক্রিকেটার মনে হবে না। আর দশজন বাঙালির মত একটা লোক তাও আবার চশমা পরা। মনে হয় কোনো পাঠশালার অংকের মাস্টারমশাই। অথচ এই লোকটাই সেই সময়ে দানবীয় সব পেসারদের খেলেছেন কোনো রকম ডর-ভয় ছাড়া।

তিনি যিখন খেলেছেন তখনো ক্রিকেটে হেলমেট বলতে কিছু আসেনি। তবে চশমা পড়া ওই লোকটাই তখন ভারতের সেরা ওপেনার। তাঁকে দেখেই তখন ভারতের গ্রেট ক্রিকেটার চাঁদু বোর্দে বলেছিলেন, ‘আমি কখনো রায়ের মত ট্যাকনিকাল ব্যাটসম্যান দেখিনি।’

ভারতের হয়ে মোট ৪৩ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন পঙ্কজ রায়। সেখানে ৩২.৫৬ গড়ে করেছেন ২৪৪২ রান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাঁচটি সেঞ্চুরিও ছিল পঙ্কজ দা’র। পেসারদের কতটা ভালো খেলতেন তিনি তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজে তাঁর ব্যাটিং পরিসংখ্যান দেখলেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজে যেই ৪ টি ম্যাচ খেলেছেন সেখানে তাঁর সংগ্রহ ৩৮৩ রান। ক্যারবীয় এই দেশটাতে তাঁর ব্যাটিং গড় ৪৭.৮৭। এছাড়াও লর্ডসে একটি টেস্টে প্রথম বাঙালি হিসেবে ভারতের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ি, পঙ্কজদের আদিবাড়ি

বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা ওপেনিং পার্টনারশিপ ও করেছিলেন এই ব্যাটসম্যান। ১৯৫৬ সালে ভারতে টেস্ট সিরিজ খেলতে আসে নিউজিল্যান্ড। তখনই পঙ্কজ দা’র চোখে সমস্যা দেখা গেল। ডাক্তারের পরামর্শে চশমা পরা শুরু করলেন। চশমা পরেই নিউজিল্যান্ডের সাথে টেস্ট খেলতে নামলেন বাংলার এই রাজা। তখন তাঁর ওপেনিং পার্টনার ভিনোদ মানকাদের সাথে করেছিলেন ইতিহাস গড়া জুটি।

প্রথম দুইদিনেও একটা উইকেট পায়নি নিউজিল্যান্ডের বোলাররা। তৃতীয় দিনের সকালে এই পার্টনারশিপ গড়ালো ৪০০ রানে। ভিনোদ মানকাদ ডাবল সেঞ্চুরিও করলেন। পঙ্কজ রায়ের সামনেও সুযোগ ছিল ডাবল সেঞ্চুরি করার। কিন্তু ওইযে বলেছিলাম সৌরভরা চাইতেন পঙ্কজ দা’র মত হতে। এমনি এমনি তো আর ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী অধিনায়ক তাঁর মত হতে  চাইতেন না।

সেদিন পঙ্কজ রায় খেলছিলেন ম্যাচটা জেতার জন্য। তাই তাঁর ডাবল সেঞ্চুরির দিকে মাথা না ঘামিয়ে সে কিউই বোলারদের ওপর চড়াও হয়। শেষে ৪১৩ রানে গিয়ে থামে ইতিহার গড়া সেই পার্টনারশিপ। ১৯৫৬ সালের সেই পার্টনারশিপের রেকর্ড ভাঙে ঠিক ৫২ বছর পর।

ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও রীতিমত রাজত্ব করেছিলেন তিনি। ১৮৫ টেস্ট ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ১১৮৬৮ রান। ৩৩ টি সেঞ্চুরি সহ তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৪২.৩৮। অথচ কলকাতার মাঠেঘাঠে প্রায়ই তাঁকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। বাংলার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন শুধুই পঙ্কজ দা। এমনি ফুটবলটাও বেশ ভালো খেলতেন তিনি। সেই সময়ের ফুটবল কিংবদন্তী চুনী গোস্বামী বলেছিলেন পেশাদার ফুটবলার হতে পারতেন পঙ্কজ। সেই সময়ে বাংলায় ফুটবলের তুমুল জনপ্রিয়তা থাকার পরেও ক্রিকেটটাকেই বেঁছে নেন তিনি।

১৯৬০ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন এই কিংবদন্তি। ১৯৮৩ সালে ভারতে যেই দলটা বিশ্বকাপ জিতলো সেই দলটার নির্বাচক ছিলেন পঙ্কজ রায়। ২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মস্থান কলকাতাতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। রেখে যান একটি ঐতিহ্য।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link