লম্ফ জ্বলছে শহরে। গ্যাসবাতি, ইলেকট্রিক লাইট – অন্ধকার শহরে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিচ্ছে ঐ লম্ফর রোশনাই। খবরের কাগজে পাতা ওল্টাতে চোখে পড়ছে আনন্দবাজারের ফ্রন্টপেজে যোগেন চৌধুরীর আঁকা মা দূর্গা। শহরের অলিতে গলিতে আর্ট আর আর্টিস্টের একটা গোটা ঝাঁকের পেছনে ছুটছে কাতারে কাতারে মানুষ। শুধু একবার তারা নারায়ণ সান্যালকে দেখতে চান। রূপমঞ্জরীর স্রষ্টাকে চোখের দেখা দেখতে চান। আপনমনে হাসেন বিভূতিভূষণ।
মাইলস্টোনের ফলক দেখে নম্বরজ্ঞান অর্জনের দিন গত। প্রবল সারল্যে ভরা চোখ নিয়ে বিস্ময় বালক ফুটবল খেলছেন আর্টের আঁতুড়ঘর ইতালিতে। ফ্র্যাঙ্কো বারেসি বলেছেন ওকে কিছু শেখানোর নেই। সে ছেলে নাকি জুভেন্তাসের ভক্ত। শুনে বাবা বলেছেন মিলানের জন্য তোমার পূর্ণপ্রাণ উৎসর্গ করো।
ছেলে কথা শুনছে, ফুটবল খেলছে, ১৯৮৪ সালে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধী খুন হলেন। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮৪। কলকাতার একঝাঁক যুবক অমিতাভের শরাবী দেখে ফেটে পড়ল। আর করতালিতে ভেসে গেল ইডেন। নতুন নাম মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। ইতালিতেও নতুন নাম। পাওলো মালদিনি। জাত শিল্পী। আর্টের কদর জানে। জানে, জানাচ্ছে মানুষকে। দু’নয়নে ভরা বিস্ময় নিয়ে সমগ্র বিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে তাঁদের।
অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি। অবাক। অতি প্রাচীন শব্দ। মানুষ অবাক হতে ভালবাসে। অবাক, সবাককে দূরে সরিয়ে রেখে নীরবে ভীড়ের মাঝে দাঁড়ানো এক দিওয়ানা। ঐ বলটা আসছে। রবার্তো কার্লোস তুলল বিশাল ক্রস। বলটা যেখানে পড়বে, সেখানেই একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।
লোকটা জাতে আলজিরিয়ান, নাগরিকত্বে ফরাসি। লোকটা কলকাতার রাস্তায় ফুটবল খেলত। লোকে জানত মার্সেইতে বড় হয়েছে। নাহ্, ভুল। বলটা মাটিতে পড়েনি। গোটা এরিনাকে অবাক ক’রে বাঁ পায়ে দুরন্ত ভলি। ছুটে যাচ্ছে জিদান, অসহায় ভঙ্গিতে কোমরে হাত দিয়ে হারের হতাশাকে গায়ে জড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে এক জার্মান। মাইকেল বালাক।
ঐ ওইটুকুই। বল মাটিতে পড়বে না। টার্গেট মিসও হবে না। অথচ অবাক হবেই দর্শক। অবাক, অবাক। শিল্পতে অবাক না হলে আর কিসে হবে কালীনাথ? অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘নানা রঙের দিন’। মদ্যপ অভিনেতার ট্র্যাজেডি। যা দেখে অবাক হয়েছিল কলকাতার শিল্পমনস্ক ব্যক্তিগণ। মালদিনি অবাক করতেন। কার্ড না দেখে কড়া ট্যাকলে ভিঞ্চির ছোঁয়া দিয়ে দিতেন। ফাউল না করেও বল চলে আসছে পায়ে। একবার, দু’বার নয় – বারবার। ২৫ বছর। ১৯৮৪ থেকে ২০০৯।
টাকমাথা লম্বা লোকটা ডান পা, বাঁ পায়ে বল জাগলিং করছে। নাটমেগ করছে, রুলেট ক’রে পর্তুগালের ডিফেন্ডারদের অবাক করছে। ঐ শিল্পীটাই রেগে গিয়ে ঢুঁসো মেরে লাল কার্ড দেখে ফেলেছে। কী হবে? কিছুই না। জিদান টানেল দিয়ে বেরিয়ে যাবেন। ফিরে আসবেন ঐ টানেলেই, কয়েক বছর পর। মাদ্রিদকে তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাবেন। মালদিনি সান সিরো এরিনার একদম ওপরে বসে দেখবেন ছেলে ড্যানিয়েলের খেলা। গর্ববোধ করবেন। নীরবে ভাববেন এসি মিলানের স্বর্ণযুগের গল্প।
শিল্প, ছোঁয়া, অবাক, টাচ, তুলি, পূজারি, জিদান, মালদিনি – সব সমার্থক। সব সম্পর্ক, সব স্মৃতি লিখে, বলে, সিনেমা করে, গান গেয়ে বোঝানো দূরহ। আবার, তাদের বুঝতে ও বোঝাতে গেলেও কোনও না কোনও আর্টফর্মকে টেনে ধরছি আমরা অবাক দর্শকরা। অবাক পৃথিবী, জিদান-মালদিনিকে দিয়েছিলে তুমি।