১৯৪৭ সালের আগস্ট। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল দুইটি দেশের। ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশকে খণ্ডিত করে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুইটি আলাদা দেশ সৃষ্টি করে ইংরেজরা। সেদিন শুধু দুইটি দেশ নয়, এই বিভাজন ক্রীড়া জগতের অন্যতম সেরা দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল তৈরি করেছিল।
বর্তমান সময়ে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে আগ্রহী উদ্দীপনার শেষ। দর্শকদের হিসেবে বৈশ্বিক ক্রীড়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লড়াই এটি। আর এই লড়াইয়ে জয়-পরাজয় দেয় দুইটির জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারত এবং পাকিস্তানের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বীতা এতই বেশি যে তারা একইদিনে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে না। পাকিস্তান ১৪ আগস্ট এই দিন পালন করে অন্যদিকে ভারত ১৫ আগস্টকে স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা দিয়েছে। অথচ একইদিনের বিভাজন দুইটি দেশকে স্বাধীনতা দিয়েছিল।
ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীও বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন পর্যন্ত চারবার এই দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়েছিল। একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এই যে মানসিকতা – এটিই ক্রিকেটের মাঠে পাক-ভারত লড়াইকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরামের মতে, ‘ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ লাখ লাখ মানুষের আবেগ জড়িত থাকে। এই ম্যাচে একটা ভাল পারফরম্যান্স যে কাউকে জাতীয় নায়কে পরিণত করতে পারে। আবার উল্টো হলে অর্থাৎ দল হারলেও কিংবা বাজে পারফরম্যান্স করলে হতে হয় ভিলেন।’
রাজনৈতিক সহিংসতা অবশ্য খেলার মাঠেও চলে এসেছে। তাই ২০০৭ সালের পর থেকে ভারত এবং পাকিস্তানের মাঝে কোন দ্বিপাক্ষিক সিরিজ অনুষ্ঠিত হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে সাদা পোশাকে এই দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বৈরথ দেখার সুযোগ হয়নি নতুন দিনের ক্রিকেট ভক্তদের। শুধুমাত্র বিশ্বকাপ কিংবা এশিয়া কাপের মত বড় বড় টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ দেখা যায়।
আর এসব ম্যাচ চলাকালীন সারাবিশ্বের সমর্থকদের নজর আটকে যায় টিভি পর্দায়। ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পাক-ভারত ম্যাচ ২ কোটি ৭৩ লক্ষ বার দেখা হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচটি দেখা হয়েছে ১ কোটি ৬৭ লক্ষ বার। কিছুদিন পরেই এশিয়া কাপে পুনরায় মুখোমুখি হতে যাচ্ছে এই দুই দল, সেই ম্যাচ নিয়েও উৎসাহের কমতি নেই কারো।
সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫৯ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে ভারত এবং পাকিস্তান। এর মাঝে পাকিস্তান ১২টি এবং ভারত নয়টি ম্যাচ জিতেছে – বাকি ম্যাচ ড্রতেই নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া ওয়ানডেতেও মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে আছে পাকিস্তান। তবে টি-টোয়েন্টিতে জয়ের পাল্লা ভারতের দিকেই ভারী।
পাকিস্তানকে ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জেতানো ইমরান খান স্কাই স্পোর্টসের একটি ডকুমেন্টারিতে বলেন, ‘পাকিস্তান-ভারত দ্বিপাক্ষিক সিরিজের সাথে কোন কিছুরই তুলনা হয় না। এটা সম্পূর্ণ অনন্য একটি ক্রিকেটীয় লড়াই।’ সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমাদের সাথে ভারতের ম্যাচ চলাকালীন সবার মাঝে থাকে আনন্দ আর উত্তেজনা, উদ্বেগ আর উত্তাপ।’
অন্যদিকে ভারতের সাবেক ব্যাটসম্যান সঞ্জয় মাঞ্জরেকার পাকিস্তানকে তাঁর প্রিয় প্রতিপক্ষের মর্যাদা দিয়েছেন। তাঁর মতে, পাকিস্তান ভাল প্রতিপক্ষ তো বটেই, আবার মাঠের খেলায় তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এক ভিন্নরকমের বিনোদন।
এছাড়া পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চিফ এক্সিকিউটিভ ফয়সাল হাসনাইন ইন্দো-পাক ম্যাচকে সব ক্রিকেট ম্যাচের জননী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এএফপিতে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, ‘ভক্তরা নিয়মিত এই দুই দেশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে চায়। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবেশের কারনে সেটি আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। তবে আশা করা যায় খুব দ্রুত হয়তো ভারতের সাথে পাকিস্তানকে সিরিজ খেলতে দেখা যাবে।’
গোলাগুলি বিহীন পাক-ভারত যুদ্ধের স্বাদ নিতে উদগ্রীব হয়ে আছে বিশ্বের সব ক্রিকেটপ্রেমী। রাজনৈতিক সহিংসতা দূরে রেখে নিয়মিত ভারত-পাকিস্তান সিরিজ মাঠে গড়াবে এমনটাই স্বপ্নে দেখে তারা।