পল কুদ্দুস এখন অফিস সহকারী

আগে বলুন, পল অ্যাডামসের কথা কী মনে আছে?

হ্যাঁ, ভুতুড়ে অ্যাকশনের চায়নাম্যান সেই বোলার। এক সময় সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দেওয়া পল অ্যাডামসের ক্যারিয়ার খুব লম্বা ছিল না। কিন্তু অ্যাকশনের কারণে এখনও তিনি অনেকের কাছে তারকা। সেই পল অ্যাডামস ক’দিন আগে টুইটারে একটা ভিডিও পোস্ট করেছেন; লিখেছেন-সে এখন কোথায়, জানতে ইচ্ছে করে।

সে কী! পল অ্যাডামস কাকে খুঁজছেন?

ভিডিওটাতে চোখ বোলালে বিস্ময়টা আরেকটু বাড়বে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ৯-১০ বছর বয়সী এক বালক ঠিক পল অ্যাডামসের মতো অ্যাকশনে চায়নাম্যান বল করছে। তাঁর প্রশংসা করছেন ক্রিকেট গ্রেট, অরবিন্দ ডি সিলভা। আরেকটু ভালো করে কথাগুলো শুনুন। শুনতে পাবেন, এই ভুতুড়ে অ্যাকশনে বল করতে থাকা বালকটি এই বাংলাদেশের একটি ছেলে।

এতক্ষণে আপনার মনে যাওয়ার কথা পল অ্যাডামস কার কথা বলছেন। হ্যাঁ, পল কুদ্দুস; আমাদের আব্দুল কুদ্দুস। তাঁকেই খোঁজ করছিলেন পল অ্যাডামস।

নব্বই দশকের একেবারে শেষ দিকে এই ঢাকায় শ্রীলঙ্কা দলের নেটে পল অ্যাডামসের মতো করে বল করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন কুদ্দুস। সংবাদপত্রে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল-পল কুদ্দুস।

কিন্তু সেই ঘটনার পর একেবারে হারিয়েই গিয়েছিলেন পল কুদ্দুস। পল অ্যাডামস টুইট করার পর শুরু হয়েছে পল কুদ্দুসকে নিয়ে খোঁজাখুঁজি। তারই এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে পল কুদ্দুসের বর্তমান অবস্থা। এক বেসরকারী ব্যাংকের অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করছেন এখন তিনি।

আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে হইচই ফেলে দেওয়া কুদ্দুসের এই পরিণতি হলো কিভাবে! সেই গল্প শোনার আগে আমরা বরং শুরু থেকে গল্পটা শুনে আসি।

কুদ্দুসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মতিঝিলের আশেপাশে। মূলত আরামবাগের ছেলে তিনি। জন্মের আগেই বাবা চলে গেছেন সংসার ছেড়ে। মা কোনোক্রমে বড় করার চেষ্টায় ছিলেন ছেলেটাকে। কুদ্দুস সেভাবে তখনও স্কুলে যাওয়া বা অন্যান্য সুবিধা পাননি। মূলত মোহামেডান ক্লাবে টুকটাক কাজ করাই তার জীবন ছিল। সেখানেই শখের বসে টুকটাক বোলিং করতেন।

শুরু থেকেই কুদ্দুস চায়নাম্যান বোলার ছিলেন; বাম হাতে লেগস্পিন করতেন।

একদিন টিভিতে পল অ্যাডামসের বোলিং দেখলেন। দেখে নিজের অ্যাকশন একটু বদলালেন। পল অ্যাডামসের মতোই ঘাড়ের ওপর থেকে হাত এনে মাথাটা মাটির দিকে করে উল্টে বল ডেলিভারি দেওয়া শুরু করলেন। তার এই অ্যাকশন নিয়ে হাসি ঠাট্টা হলো। কিন্তু কুদ্দুস যে একটা বড় ব্যাপার করে ফেলেছেন, সেটা প্রথম ধরতে পারলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা। সম্ভবত ১৯৯৭ সালে রানাতুঙ্গা মোহামেডানে খেলতে এলেন।

নেটের পাশে কুদ্দুসকে তিনি দেখলেন ওভাবে বল করতে। বিদ্যুৎ চমকের মতো তিনি বুঝে ফেললেন, এই ছেলে বড় একটা ব্যাপার হতে যাচ্ছে। তাঁকে নেটে ডাকলেন। বল করতে বললেন এবং কয়েক বার তার বলে আউট হলেন। সাথে ছিলেন রমেশ কালুভিতারানা। তিনিও অবাক হয়ে গেলেন এই বোলিংয়ে। রানাতুঙ্গার আগ্রহেই মোহামেডান নেটে নিয়মিত হলেন কুদ্দুস।

এরপর আর্ন্তজাতিক হইচইটা শুরু হলো ১৯৯৮ সালে। ‘মিনি বিশ্বকাপ’ ডাক নামে আইসিসি নক আউট ট্রফির আসর বসলো এখানে। রানাতুঙ্গা দেশে বসেই কুদ্দুসের কথা বলেছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভাকে। তারা কুদ্দুসকে খোঁজ করছিলেন। এদিকে কুদ্দুসও চেষ্টা করছিলেন রানাতুঙ্গার সাথে দেখা করার।

শ্রীলঙ্কা দলের বাংলাদেশি লিয়াজো অফিসারের সাথে কুদ্দুস দেখা করলেন। বললেন, ‘আমাকে রানাতুঙ্গা চেনে। ওর কাছে যেতে চাই।’

কুদ্দুসকে নিয়ে যাওয়া হলো নেটের কাছে। হইচই পড়ে গেল। কুদ্দুস নেটে এবার বল করতে শুরু করলেন অরবিন্দ ডি সিলভাকে। বেশ কয়েকবার পরাজিত হলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ডি সিলভার। আর দৃশ্য চোখে পড়লো ধারাভাষ্যকার ও কিংবদন্তী ক্যারিবিয় ফাস্ট বোলার মাইকেল হোল্ডিংয়ের। তিনি পরদিন ম্যাচের আগে ডি সিলভা আর কুদ্দুসকে আনলেন ক্যামেরার সামনে।

ডি সিলভা বললেন, ‘ওর নাম কুদ্দুস। ও কয়েক দিন ধরেই আমাদের নেটে বল করছে। অসাধারণ এক প্রতিভা। আমি মনে করি, সে অনেক দূর যাবে। ওকে মূলত আবিষ্কার করেছে অর্জুনা। সে এখানে ক্লাবে (মোহামেডান) খেলতে এসে প্রথম এই ছেলেটিকে দেখে।’

এই কথা বলার পর হোল্ডিং ডি সিলভাকে অনুরোধ করেন কুদ্দুসের দুটি ডেলিভারি খেলার জন্য। দ্বিতীয় ডেলিভারিতেই বলের লাইন মিস করলেন ডি সিলভা। মাঠে হইচইয়ের শব্দ শোনা গেল। এরপর তার বোলিং গ্রিপ নিয়ে ধারাভাষ্য বক্স থেকে বিশ্লেষন করেন আরেক কিংবদন্তী টনি গ্রেগ। টনি বলছিলেন, পল অ্যাডামসের তুলনায় ‘অর্থোডক্স’ গ্রিপ হলেও কুদ্দুসের বোলিং বেশি কার্যকর।

এরপর বাংলাদেশ দলের নেটেও বল করেন পল কুদ্দুস। পরদিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক মানবজমিনে সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার এম এম কায়সার লিখেছিলেন-বাংলাদেশের নেটে ‘পল কুদ্দুস’। এখান থেকেই মূলত পল কুদ্দুস নামটা খ্যাতি পায়।

সেই সময়ের কথা মনে করতে গিয়ে এম এম কায়সার বলছিলেন, ‘ওকে নিয়ে তখন খুব হইচই হয়েছিল, মনে আছে। শ্রীলঙ্কার নেটে ও যখন বল করতো, তারকা খেলোয়াড়রা চেয়ে চেয়ে ওর বোলিং দেখতো। টুর্নামেন্ট কাভার করতে আসা লিজেন্ডারি সব সাবেক ক্রিকেটাররা অবাক হয়েছিলেন ওকে দেখে।’

আর কুদ্দুস সেই দিনের কথা মনে করে বলছিলেন, ‘তখন যে কত সাক্ষাৎকার দিয়েছি, কত ছবি তুলেছে সাংবাদিকরা! যেখানে যেতাম, সবাই বোলিং দেখতে চাইতো।’

এরপরও গল্পটা চলেছে।

কুদ্দুস আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ক্যাম্প ট্যাম্পে সুযোগ পাননি। তবে এর মধ্যে এসেছিলেন একটা ক্যাম্প পরিচালনা করতে বিষেন সিং বেদী। কুদ্দুস জানালেন, বেদীও সেখানে তাঁর বোলিং দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন। বেদী তাঁকে একটা স্কুলে ভর্তিও করে দিয়ে গিয়েছিলেন।

ওদিকে অর্জুনা রানাতুঙ্গা বলেছিলেন, কুদ্দুসকে শ্রীলঙ্কা নিয়ে যাবেন। সে জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) এক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন তিনি।

গল্পটা এখানে থেকে মধুরেণ সমাপয়েত হতে পারতো।

সিনেমা হলে দেখা যেত কুদ্দুস এরপর শ্রীলঙ্কা গিয়ে ট্রেনিং করছেন। বড় হয়ে সাকিব-তামিমদের সাথে জাতীয় দলে খেলছেন। তাকে নিয়ে গর্ব করছেন রানাতুঙ্গা, ডি সিলভা।

কিন্তু, না। জীবনটা সিনেমা নয়। তা কিচ্ছু হয়নি।

এরপর কার্যত কুদ্দুসের আর কেউ খোঁজ নেয়নি। কুদ্দুস বহু চেষ্টা করেও রানাতুঙ্গার বলে যাওয়া সেই কর্মকর্তার মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা যেতে পারেননি। মোহামেডান দলের সাথে থাকতেন। কিন্তু কোথাও কেউ খেলার সুযোগ দেয়নি। তৃতীয় বিভাগের একটা দলে চেষ্টা করেছিলেন খেলার; ম্যাচ পাননি।

পেছন ফিরে দেখতে গিয়ে কুদ্দুস বলেন, ‘আমাদের কোচ-কর্মকর্তারা লেগ স্পিনটাকেই পাত্তা দিতে চান না। আর তো চায়নাম্যান। এই দেশের ক্লাব ক্রিকেটে ভিন্ন ধরণের অ্যাকশনের কোনো বোলারকে কেউ সুযোগ দিতে চায় না। যে জন্য লেগ স্পিনার নাই দেখবেন; চায়নাম্যান কল্পনাও করা যায় না।’

এই প্রত্যাখ্যানের ফলে ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা কার্যত শেষ হয়ে গেল কুদ্দুসের। তারপরও তিনি মোহামেডান ছাড়েননি। টিম বয় হিসেবে দলের সাথেই ছিলেন। তামিমদের পর্যন্ত বল থ্রো করেছেন। তামিমের সাথে ভালো সম্পর্কও ছিল। এর মধ্যে ক্লাবের অভ্যন্তরীন কিছু বদল ঘটলো। সে কাজটাও হারালেন কুদ্দুস।

কেবল ক্রিকেট ভালোবাসা তো বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। কুদ্দুসের তাই একটা কাজ দরকার ছিল। এই সময় কুদ্দুসের পাশে এসে দাঁড়ালেন মোহামেডানের কিংবদন্তি রকিবুল হাসান। তিনি তখন ট্রাস্ট ব্যাংকের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনিই এই ব্যাংকে একটা কাজ জোগাড় করে দিলেন। সেই থেকে কুদ্দুস এই ব্যাংকেই অফিস সহকারী হিসেবে আছেন।

ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা আছে। সেই ভালোবাসা থেকে মোহামেডানের সমর্থকদের একটা ফেসবুক গ্রুপও করেছিলেন। সেটাও নানা জনের আপত্তিতে না টেকার অবস্থা।

কুদ্দুস নীরবে চা নিয়ে ছোটেন, মাঝে মাঝে টিভিতে খেলা দেখেন। কাউকে নিজের অতীতের গল্প বলেন না। কেবল টিভিতে কোনো চায়নাম্যান বোলারের বোলিং দেখলে বুক চিরে বের হয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস-হয়তো আমিও….

না, কুদ্দুস এখন স্রেফ অফিস সহকারী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link