পেলে, ঘোরলাগা এক অনুভূতির নাম

মর্ত্যলোকে পায়ের জাদুতে গোটা বিশ্বকে মোহনীয় মুগ্ধতা আর বিস্ময়ে ভাসানো এক জাদুকর ঐ দূর আকাশে পাড়ি দিয়েছেন। সেই দূর আকাশে চিরন্তন হিসেবে যুক্ত হয়ে গেছে ঐ জাদুকরের নাম। নাম তাঁর পেলে।

অস্বচ্ছ শীতের আকাশ। দিবালোকের আলোও যেন ঠিক কুয়াশার ধূসরতায় পেরে ওঠে না। এক ফালি রোদ্দুর হয়ে ওঠে প্রবল প্রতীক্ষার বিষয়। তবে আজকের শীতের আকাশটা বড্ড বেশি ভারি। থমথমে আবহে ঠিক যেন শুনশান নিরবতা। এ নিরবতা ধাক্কা দেওয়ার মতো একটি শোকে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার মতো এক অনুভূতি।

মর্ত্যলোকে পায়ের জাদুতে গোটা বিশ্বকে মোহনীয় মুগ্ধতা আর বিস্ময়ে ভাসানো এক জাদুকর ঐ দূর আকাশে পাড়ি দিয়েছেন। সেই দূর আকাশে চিরন্তন হিসেবে যুক্ত হয়ে গেছে ঐ জাদুকরের নাম। নাম তাঁর পেলে।

শোকের রঙ রঙিন হয় না। এক ধরনের আঁধার ঘিরে ধরে চারপাশ। পেলের মৃত্যু গোটা বিশ্বে সেই স্তব্ধতা, রূদ্ধতাই তৈরি করেছে। শোকে মুহ্যমান হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। এ এক অদ্ভূত শুন্যতা। জীবন্ত কিংবদন্তি থেকে জীবন্ত শব্দটাই বাদ। কী সব অসহ্যকর, অপ্রত্যাশিত শব্দমালার নিষ্ঠুর বাস্তবায়ন।

দাসপ্রথার চল ব্রাজিলে শুরু থেকেই ছিল। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এসে সেই প্রথার অবসান ঘটে। আর সেই ‘কালো’ দের দলেরই লোক ছিলেন পেলে। কে জানতো, এক সময় দাসপ্রথার শিকলে বিদ্ধ হতে থাকা তাদের বংশেরই একজন পুরো ব্রাজিলিয়ানদের উৎসবের কেন্দ্র হবেন,গোটা ব্রাজিলকে নিয়ে যাবেন বৈশ্বিক এক মহিমায়। হ্যাঁ। গোটা বিশ্ব দশকের পর দশক ধরে ব্রাজিলকে চিনে আসছে ঐ পেলের বদৌলতেই।

ফুটবলকে যে বিশালতা তিনি দিয়েছেন তা নির্ণয় করা রীতিমত অসম্ভব। ব্রাজিলের তিন তিনটি বিশ্বকাপ শিরোপার পথের দিশারী ছিলেন তিনি। ক্যারিয়ারে যেভাবে গোলের বন্য বইয়েছেন তাতে খাবি খেয়েছে ফুটবল পরিসংখ্যানবিদরাও। সেটা অবশ্য অনুমিতই। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে যে পরিমাণ গোল করেছেন তার ডেটা অনেক সময় রেকর্ডবুকেও বন্দী হয়নি। তাই কেউই নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন না, ক্যারিয়ারে পেলের গোলসংখ্যা ঠিক কতটা। কেউ বলেন ৭৫৭ টা, কেউ বলেন ১২৮২, আবার কেউ বলেন ১০৮৮। সে যাই হোক, কথিত কিংবা মতাভেদ সূত্রে পেলের গোলসংখ্যা নিশ্চিতভাবে সহস্র ছাড়িয়েছে।

পেলের কীর্তিগাঁথা কিংবা তাঁর ফুটবল অর্জন নিয়ে কলেবরের পর কলেবর বৃদ্ধি করে শব্দের পসরা সাজানো যায়। তাতেও বোধহয় বিশেষণ ব্যবহারের সংকটাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে পেলের এমন সব কিছু কর্মকান্ড আছে যা তাঁকে একজন মানুষ হিসেবেও অনেক মহান করে তোলে।

শোনা যায়, একবার নাকি এক দেশের গৃহযুদ্ধ থামিয়েছিলেন পেলে। আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় তখন চলছিল গৃহযুদ্ধ। নাইজেরিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বায়াফ্রা’। কিন্তু মুশকিলটা হলো অন্য জায়গায়। নাইজেরিয়ার ঐ ঘোষণার পর দুটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ‘ইগাবো’ ও ‘হাউস’ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সেই সংঘর্ষ যে নিছকই কোনো সংঘর্ষ ছিল না তা বুঝা যায় হতাহতের সংখ্যা দেখ। সে সময় প্রায় এক লাখের মানুষ নিহত হয়েছিল।

নাইজেরিয়ার এমন অস্থিতিশীল সময়ে ত্রাতা হিসেবে হাজির হয়েছিল পেলের ক্লাব সান্তোস। তখনকার সময়ে নাইজেরিয়ার মানুষের কাছে সান্তোস ক্লাব জনপ্রিয় ছিল। আর সান্তোস সে সময় আফ্রিকার বেশ কিছু দলের বিপক্ষে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলত। তাই নাইজেরিয়ায় খেলার সময় সান্তোস চলমান গৃহযুদ্ধ বিরতির শর্ত দিয়ে বসে। এরপর ১৯৬৯ সালে আসে সেই মুহূর্ত। সান্তোস নাইজেরিয়ায় খেলতে আসে। কিন্তু সে সময়ও গৃহযুদ্ধ চলছিল। তবে সান্তোস খেলতে আসার পর দেশটিতে হঠাতই যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা আসে।

আফ্রিকার দেশটিতে তখন অরাজকতার মাত্রা সীমাহীন হলেও তারা পেলেকে খুব পছন্দ করতো। আর এ কারণেই বিদ্বেষ, সংঘর্ষ ছাপিয়ে মুহূর্তের মধ্যে পেলে আর সান্তোস দেশটিতে একটা ঐক্যের জয়গান ছড়িয়ে দেন। সেই থেকে বহু মত বিরোধ থাকলেও বলা হয়ে থাকে, পেলে একবার গৃহযুদ্ধ থামিয়েছেন। আর একজন ফুটবলারের এমন কাজ তাঁকে মানুষের মানদন্ড বিচারে অনেক উপরে তুলে দেয়। পেলেও তাই সে বিচারে উচ্চ শিখরে উঠে গিয়েছিলেন।

৮৬ এর ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ কিংবা এবারে মেসির কাতার বিশ্বকাপ- এমন সব ট্যাগলাইনে নিজের প্রিয় ফুটবলারকে অর্জনে আকাশসম রাখার চল প্রায় ফুটবল সমর্থকদের মাঝেই আছে। কিন্তু পেলের সেই সাদাকালো সময়ে এমন উন্মাদনা খুব একটা প্রকাশ্যে আসে না। কিন্তু পেলের সময়েও ভক্তদের পাগলামির দারুণ সব ঘটনা আছে।

সাল ১৯৭০। সে বার বিশ্বকাপ বসেছে মেক্সিকোতে। পেলে এসেছেন তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে। ততদিন পেলে নিজের গ্রেটনেসে ঠিকই ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। তাই মেক্সিকোর মানুষও এক নজর পেলেকে দেখার জন্য জড়ো হয়েছিল মেক্সিকো সিটিতে। যার জন্য ফুটবল একদম শৈল্পিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েছিল তাঁর পায়ের জাদুর সাক্ষী কেইবা না হতে চাইবে। তবে মেক্সিকোর মানুষ দারুণ এক পাগলামির নজির তৈরি করেছিল। মেক্সিকো সিটির এক দেয়ালে তারা লিখে বসলো, ‘আজ আমরা কোনো কাজে যাব না। পেলে, তোমার খেলা দেখতে যাব।’

পেলে উন্মাদনা এমনভাবেই সে বছর ছড়িয়ে পড়েছিল যে, মেক্সিকোর মানুষ যথারীতি একদিন নিজেদের কর্মবিরতির ঘোষণাও দিয়েছিল। দলগত অর্জনে জাতীয় ছুটির ঘোষণার কথা- প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু একজন ফুটবলারের জন্য গণ মানুষের এমন আকুতি শেষ কবেই বা দেখা গিয়েছিল। সেখানে পেলে প্রথম, পেলেই শেষ। যাহোক, সেবার মেক্সিকোর মানুষের ভালবাসার ঠিকই প্রতিদান দিয়েছিলেন পেলে। তৃতীয়বারের মতো ব্রাজিলকে জিতিয়েছিলেন বিশ্বকাপ।

পেলে ইতিহাসখ্যাত এক নাম। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, এই নামটাই নাকি আবার পেলের নিজের পছন্দ ছিল না। পেলের বাবা মা তাঁকে নাম দিয়েছিল এডসন। এ নাম করণেও আবার রয়েছে ইতিহাস। পেলের বাবা মা টমাস আলভা এডিসনের দারুণ ভক্ত ছিলেন। তারা ঠিক করলেন, তাদের ছেলে নাম রাখবেন এডিসন। সেই অনুপ্রেরণাতেই পেলের বাবা মা ১৯৪০ সালে এডিসন থেকে তাঁর নাম রাখে এডসন।

প্রশ্নটা এখানেই, তাহলে এডসন কিভাবে পেলে হয়ে গেলেন। ছোট বেলায় তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বিলে বলে ডাকতো। তো সেই বিলে একবার বিকৃত হতে হতে ‘ব’ হয়ে যায় ‘প’। অর্থাৎ বিলের জায়গায় হয়ে যায় পিলে। আর সেই পিলে থেকেই পেলে। যে নাম দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জগতখ্যাত।

কিন্তু পেলে নামটা যে কখনোই পছন্দ ছিল না স্বয়ং পেলের। তাঁর বাবা মায়ের দেওয়া সেই এডসন নামটাকেই তিনি লালন করতে চাইতেন। কিন্তু তিনি গোটা বিশ্বের কাছে হয়ে উঠলেন পেলে। পেলের অন্তলোক যাত্রায় তাই এডসন নামে বিদায় হলেও নশ্বর এ পৃথিবীতে তিনি ঠিকই টিকে থাকছেন পেলে নামেই। দিনশেষে, এ নামটা তো আর মুছে যাওয়ার নয়। চিরকাল জ্বলজ্বল করে রাখার মতো দুই বর্ণযুক্ত এক নাম পেলে। তাই বলাই যায়, জীবন নদীর ওপারে গিয়েছেন এডসন, পেলে নয়। কারণ পেলে নামটাই তো এক ঘোরলাগা অনুভূতি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...