সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? এই প্রশ্নের উত্তরে সবার উপরের দুইটি নাম পেলে-ম্যারাডোনা। দুজনেই পায়ের জাদুতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন পুরো বিশ্বকে। বারবার দর্শকদের ভাসিয়েছেন সৃষ্টি সুখের আনন্দ উল্লাসে। ফুটবলের সর্বোচ্চ ট্রফি বিশ্বকাপ ফুটবল, পেলে জিতেছেন তিনবার।
অন্যদিকে ম্যারাডোনা একবার জেতার পাশাপাশি দলকে ফাইনালে নিয়ে গেছেন একবার। শিরোপা সংখ্যায় পেলে এগিয়ে থাকলেও দর্শকদের মণিকোঠায় ম্যারাডোনা স্থান করে নিয়েছেন তুলনামূলক দুর্বল দলকে জেতানোর জন্য। তবে দুজনে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে খেললেও একটা ব্যাপারে ফুটবল বিধাতা তাদের মিলিয়েছে এক বিন্দুতে, দুই মহারথীর কেউই যে কোপা আমেরিকা জিততে পারেননি একবারও। আসুন দেখে নেয়া যা মহাদেশীয় সেরার এই লড়াইয়ে তাদের দু’জনের পারফরমেন্স।
ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই রীতিমতো সুপারস্টার বনে যান পেলে। ১৯৫০ সালের মারাকানাজো’র দুঃখ ভুলিয়ে পেলে তখন জাতীয় বীর। ১৯৫৯ কোপা আমেরিকাতে পেলে খেলতে যান তাই দলের মূল ভরসা হয়েই। ১৯৫৯ সালের কোপা ছিল লিগ ফরম্যাটের।
সাতটি দলের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিপক্ষে খেলবে, পয়েন্ট তালিকায় এগিয়ে থাকা দল চ্যাম্পিয়ন হবে। প্রথম ম্যাচেই পেরুর বিপক্ষে গোল পান পেলে। কিন্তু ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও পেরুর কিংবদন্তি হুয়ান সিমিনারিওর জোড়া গোলে ড্র করে বসে ব্রাজিল। পরের ম্যাচেই জোড়া গোল করেন পেলে, চিলির বিপক্ষে ব্রাজিলের জয়টাও আসে ৩-০ গোলের বড় ব্যবধানে।
পরের ম্যাচেও গোলের ধারা অব্যাহত রাখেন তিনি, বলিভিয়াকে সেলেসাওরা হারায় ৪-১ গোলে। উরুগুয়ের বিপক্ষে গোল না পেলেও বারবার আক্রমণ করে উরুগুয়ের রক্ষণভাগকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন পেলে। টুর্নামেন্টে একমাত্র উরুগুয়ের বিপক্ষেই গোল পাননি তিনি। যদিও তাতে ব্রাজিলের জয় পেতে সমস্যা হয়নি। তবে উরুগুয়ের বিপক্ষে গোলশূন্য থাকার পুরো ঝড়টা যায় প্যারাগুয়ের উপর দিয়ে, পেলের হ্যাটট্রিকে ব্রাজিল জিতে ৪-১ গোলে।
অন্যদিকে সেবারের স্বাগতিক দল আর্জেন্টিনাও ছিল ফর্মের তুঙ্গে, নিজেদের সব ম্যাচ জিতে থাকায় অঘোষিত ফাইনালে তাই কিছুটা এগিয়ে থেকেই শুরু করে আআলবিসেলেস্তেরা। তাদের প্রয়োজন ছিল কেবল ড্র, অন্যদিকে ব্রাজিলের সামনে জয়ের বিকল্প ছিল না। নির্ভার থাকার সুবিধা নিয়ে ম্যাচের শুরুতেই এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু দলকে সমতায় ফেরাতে সময় নেননি পেলে, ৬০ মিনিটে গোল করেন তিনি।
কিন্তু, গোল হজম করার পর রক্ষণাত্নক খোলসে ঢুকে পড়ে আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। বাকি সময়গুলোতে তাই বারবার চেষ্টা করেও ডিফেন্স ভাঙতে পারেননি পেলে-গারিঞ্চা-ভাভারা। সেবার তাই রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। তবে ৮ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পাশাপাশি সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে নেন পেলে।
ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন কোপা আমেরিকাকে কখনোই গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। পরের দুটি টুর্নামেন্টে ফর্মের তুঙ্গে থাকা পেলেকে তারা দলেই রাখেনি। এমনকি টানা আট বছর কোনো কোপাতে অংশ নেয়নি তারা। ফলশ্রুতিতে পেলের কাছে কোপা তাই হয়ে আছে এক দু:খের নাম।
পেলের এক টুর্নামেন্টের বিপরীতে ম্যারাডোনা খেলেছিলেন তিনটি কোপা। কিন্তু শিরোপা মেলেনি তার ভাগ্যেও। ১৯৭৯ সালে প্রথম কোপা খেলার সুযোগ পান তিনি। কিন্তু সেবার জঘন্য ফুটবল খেলে আর্জেন্টিনা, গ্রুপপর্বে ৪ ম্যাচে কেবল এক জয় পায়। ফলে দ্বিতীয় রাউন্ডে আর কোয়ালিফাই করতে পারেনি।
ম্যারাডোনা পরবর্তী কোপা খেলেন ১৯৮৭ সালে। ততদিনে ম্যারাডোনা নিজেকে ফুটবল ঈশ্বর হিসেবে একরকম প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন, আগের বছরই মিডিওকোর আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন প্রায় একা হাতে। সেই বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলারের খেতাবও জিতেন তিনি।
বলা যায় এক প্রকার টুর্নামেন্ট শুরু আগেই সবাই ধরে নিয়েছিলেন এবারের কোপা যাচ্ছে আর্জেন্টিনাতেই। শুরুটাও দারুণ করেন ম্যারাডোনা, গ্রুপপর্বের দুই ম্যাচেই করেন ৩ গোল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। সেমিফাইনালে অপ্রত্যাশিতভাবে উরুগুয়ের বিপক্ষে নিজের ছায়া হয়ে থাকেন ম্যারাডোনা, তার দলও হেরে যায় ১-০ ব্যবধানে। আরো একবার কোপাবঞ্চিত হন ম্যারাডোনা।
১৯৮৯ সালের কোপার ফরম্যাটটা ছিল একটু ভিন্ন রকম। দুটি গ্রুপে ৫টি করে দল ছিল। প্রতি গ্রুপ থেকে ২টি করে দল পরের পর্বে উঠে মোট ৪টি দল নিয়ে ফাইনাল রাউন্ড করা হয়। সেখানে লিগ ভিত্তিতে সেরা দলকে চ্যাম্পিয়ন করা হয়।
গ্রুপপর্বে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরের রাউন্ডে গেলেও সক্রেটিস-জিকোদের ব্রাজিলের সঙ্গে আর পেরে উঠেনি। ফলে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ১৯৯১ এবং ১৯৯৩ কোপা ম্যারাডোনা খেলতে পারেননি ডোপ কেলেংকারির কারণে, অথচ এই দুবারই কোপার শিরোপা জিতে নেয় আর্জেন্টিনা।
বিষয়টা অদ্ভুত, সর্বকালের সেরা দুই ফুটবলার জিততে পারেননি নিজেদের মহাদেশীয় সেরা খেতাব। ভাগ্যের মারপ্যাঁচে কোপা তাদের কাছে হয়ে আছে এক আক্ষেপের নাম।