২৫ নভেম্বর, ২০১৪। ক্রিকেট ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডে’ হিসেবেই পরিচিত। যে ক্রিকেট বল একজনকে নিয়ে যেতে পারে শূন্য থেকে শীর্ষে সেই ক্রিকেট বলই কিনা প্রাণ কেড়ে নিতে পারে! শেফিল্ড শিল্ডের এক ম্যাচে শন অ্যাবোটের এক বাউন্সার এসে লাগে ব্যাটার ফিল হিউজের মাথার পেছনে। হেলমেটের একটু নিচে লাগায় সরাসরি মাথায় আঘাত পান হিউজ। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলো; মৃত্যুর সাথে লড়াই করলেন দুই দিন! কিন্তু, শেষ পর্যন্ত এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারেননি তিনি। চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
২৫ নভেম্বরটা তাই অস্ট্রেলিয়াই নয় পুরো ক্রিকেট ইতিহাসের জন্য এক কালো দিন। এই ২৫ নভেম্বরেই পৃথিবিতে এসেছিলেন আরেক অজি পেসার পিটার সিডল। ২৫ নভেম্বরেই তিনি গড়েছিলেন অনন্য এক কীর্তি।
২৫ নভেম্বর, ২০১০। অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্টে ব্রিসবেনে মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। ১৯৭ রানে ৪ উইকেট নিয়ে প্রথম ইনিংসে তখন ব্যাট করছে ইংলিশরা। ইতিমধ্যেই নিজের ঝুলিতে দুই উইকেট পুরে ফেলেছেন সিডল। পঞ্চম উইকেটে ইয়ান বেলের সাথে ততক্ষণে ভীত গড়ে ফেলেছেন অ্যালিস্টেয়ার কুক।
বল করছিলেন সিডল। এক ওভারে পর পর তিন বলে তুলে নিলেন কুক, ম্যাট প্রায়র আর স্টুয়ার্ট ব্রডকে! ১১তম অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে টেস্ট ইতিহাসে গড়লেন হ্যাট্রিকের রেকর্ড। শুধু তাই নয় জন্মদিনে প্রথম কোনো বোলার হিসেবে হ্যাট্রিকের অনন্য এক কীর্তি গড়েন সিডল! হ্যাট্রিকের সাথে সাথে ক্যারিয়ারের তৃতীয় ‘ফাইফার’ তুলে নেন তিনি।
৫৪ রানে ৬ উইকেট শিকার করে নিজের জন্মদিনটা স্মরণীয় করে রেখেছিলেন সিডল। জন্মদিনে অনন্য এক কীর্তিতে নামের পাশে যোগ করেছিলেন ‘বার্থডে হ্যাটট্রিক’।
২০১০ সালের ২৫ নভেম্বরটা পিটার সিডল ও অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের জন্য ছিলো এক উজ্জ্বল দিন। ঠিক চার বছরের মাথায় এক কালো ছায়ায় আড়াল হয়ে গেলো সিডলের উজ্জ্বল রেকর্ড। পিটার সিডলের জন্মদিন আর সেই রেকর্ড নিয়ে কথা বলতে গেলে তাই না চাইতেই চলে আসে ফিল হিউজের সেই মর্মান্তিক ঘটনা। সিডলকে লিখতে বসলেও প্রসঙ্গ ক্রমে তাই চলে আসলো হিউজের কথা।
সিডলের ক্রিকেট ক্যারিয়ারটাও হতাশায় জর্জরিত। ইনজুরি আর অধারাবাহিকতায় নিজের প্রতিভা কিংবা সামর্থ্যের সিংহভাগই তিনি ক্রিকেটে দিতে পারেননি। চোখেমুখে ভয়ংকর এক আগ্রাসী ভাব। আগ্রাসন আর পেস দিয়েই যেনো গুড়িয়ে দিতে এসেছেন প্রতিপক্ষকে। কিন্তু নিজের অবহেলা আর ইনজুরি যেনো ক্যারিয়ারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সাদা পোশাকে তবু পাড়ি দিয়েছেন অনেকটা পথ, কিন্তু রঙিন জার্সিতে যে তিনি ছিলেনই উপেক্ষিত!
ক্রিকেটে পদচারণার শুরুটা বাল্যকাল থেকেই। মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই বয়সভিত্তিক দলে খেলতে শুরু করেন সিডল। খেলতেন ল্যাটরব ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। অনূর্ধ্ব ১৭ তে খেলাকালীন রাজ্যেভিত্তিক ক্রিকেটে ভিক্টোরিয়ার হয়ে রেকর্ড গড়েন তিনি। পিটার স্কলসের রেকর্ড গুড়িয়ে রাজ্যভিত্তিক ক্রিকেটে মাত্র ৪৭ রানে ম্যাচে ১১ উইকেট শিকার করেন সিডল। ভিক্টোরিয়ার হয়ে রাজ্যভিত্তিক ক্রিকেটে এটিই ছিলো সেরা ম্যাচ ফিগার।
২০০৫ সালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর কাঁধের ইনজুরিতে বেশ কিছু সময় ছিলেন বাইরে। তখন বয়সটা কম, তাই ইনজুরির সাথে পাল্লা দিয়ে ঠিক কামব্যাক করেছিলেন। এরপর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাত্র ১২ ম্যাচ খেলার পথেই প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের বিপক্ষে চার টেস্টের জন্য স্কোয়াডে জায়গা পান সিডল। অবশ্য মিশেল জনশন, ব্রেট লি, স্টুয়ার্ট ক্লার্কদের ভীড়ে একাদশে সিডলের জায়গা পাওয়াটা ছিলো বেশ কঠিন। তবে দ্বিতীয় টেস্টেই ক্লার্কের ইনজুরিতে ভাগ্য খুলে যায় সিডলের। ক্লার্কের বদলি হিসেবে সুযোগ পান তিনি। ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর মোহালিতে ভারতের বিপক্ষে সাদা পোশাকে অভিষিক্ত হন সিডল।
নিজের প্রথম উইকেট হিসেবে শিকার করেন ক্রিকেট ঈশ্বর খ্যাত শচীন টেন্ডুলকারকে! ইনিংসে ৩ উইকেট সহ ম্যাচে ৪ উইকেট নিলেও ক্লার্কের সেরে উঠায় সিরিজের বাকিটা সময় বেঞ্চেই কাটান সিডল। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে সুযোগ পান তিনি। ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ক্যারিয়ারে মেইডেন পাঁচ উইকেট শিকার করেন তিনি। পুরো সিরিজেই বল হাতে সিডল ছিলেন বেশ দাপুটে।
ওই বছরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হেডিংলিতে দেখা পান ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফাইফর। সেবার অ্যাশেজ সিরিজে ২০ উইকেট নেওয়ার পথে ক্যারিয়ার সেরা ২১ রানে ৫ উইকেট নেন সিডল। ওই বছর আইসিসি ‘ইমার্জিং প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ারের’ পুরষ্কার জেতেন তিনি। পরের বছর ২০১০ অ্যাশেজেই নিজের জন্মদিনে গড়েন সেই ‘বার্থডে হ্যাট্রিকের’ কীর্তি! ২৬ বছর বয়সে অসাধারণ এক কীর্তিতে নাম লেখান এই পেসার। সেবার আইসিসি টেস্ট বোলিং র্যাঙ্কিংয়ে ৯ এ উঠে আসেন সিডল।
২০১২ সালে সিডনিতে ভারতের বিপক্ষে নিজের শততম টেস্ট উইকেট শিকার করেন সিডল। ওই সিরিজেই উঠে আসেন টেস্টে বোলিং র্যাঙ্কিংয়ের সাতে। শেষ দুই টেস্টে ম্যাচ সেরা হওয়া সহ সিরিজে মোট ২৩ উইকেট শিকার করেন সিডল। বলতে গেলে সেটি ছিলো সিডলের ক্যারিয়ারের সেরা স্মরণীয় সিরিজ।
২০১৩ সালে প্রথম ব্যাটার হিসেবে নয় নম্বরে ব্যাট করে দুই ইনিংসেই হাফ সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন সিডল। তবে ইনজুরি আর প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারেননি তিনি। একদিকে ব্যাক ইনজুরিতে বার বার ছিটকে গেছেন দল থেকে, অপরদিকে মিশেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স, জশ হ্যাজেলউডরা দলে থিতু হওয়ায় তাদের ভীড়ে আর নিয়মিত হতে পারেননি সিডল।
সাদা পোশাকে ৬৭ টেস্টে খেললেও রঙিন জার্সিতে দেখা গেছে বিপরীত চিত্র। ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অভিষিক্ত হন তিনি। প্রথম দুই বছরে ১৭ ওয়ানডে ম্যাচে ৫ এর কম ইকোনমিতে ১৫ উইকেট। টি-টোয়েন্টির পরিসংখ্যানটা আরো বাজে!
২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেকে ২৪ রানে নেন ২ উইকেট। এমন পারফরম্যান্সের পর দেড় বছর আর দলে ডাক পাননি এই পেসার। পরের বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এক ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ৪ ওভারে ৩৪ রানের বিনিময়ে নেন ১ উইকেট। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারটা সীমাবদ্ধ ছিলো এই ২ ম্যাচের মধ্যেই!
২০১০ সালে সবশেষ রঙিন জার্সিতে মাঠে নামেন সিডল। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে আর খেলার সুযোগ পাবেন না সেটা ধরেই নিয়েছিলেন তিনি। ইনজুরি আর দলে বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় টেস্টেও নিজের শেষ সময়টা দেখছিলেন সিডল।
বয়সটাও তখন ৩৫ ছুঁইছুঁই। ২০১৮ পর্যন্ত অনেকটাই ঠেলেঠুলে ৬৭ টেস্ট খেলেছেন। অবসরের চিন্তাটাই তখন ঘুরপাক খাচ্ছিলো মনে। এরপর ২০১৯ সালে ভারতের বিপক্ষে হটাৎ করেই টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে ডাক পেয়ে যান সিডল! ২ মাস আগেও যদি সিডলকে কেউ টেস্টে খেলার কথা বলতো, তিনি বেশ কয়েকবার হয়তো ভাবতেন যে আদৌ আর সুযোগ পাবেন কিনা।
আর ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির প্রসঙ্গ আনাটা সিডলের জন্য হাস্যরস ছাড়া আর কিছুই না। ক্যারিয়ারের শুরুতে ২ বছর খেলার পরই হলুদ বাতিটি নিভে গিয়েছিলো সিডলের ক্যারিয়ারে। সেটি শেষ সময়ে এসে জ্বলার চিন্তাটা করাটা মানেই হাসির পাত্র হওয়া। কিন্তু স্বপ্নের মতোই ৯ বছর পর রঙিন জার্সিতে ২২ গজে নামার হাতছানি আবার সিডলের সামনে। ভারতের বিপক্ষে ওই সিরিজের ৩ টেস্টেই খেলেন তিনি। শিকার করেন ৭ উইকেট। ওয়ানডেতেও তিন ম্যাচে নেন ২ উইকেট। এরপরই ২০১৯ এর ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই পেসার।
সাদা পোশাকে ৬৭ ম্যাচে নিয়েছেন ২২১ উইকেট। পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ৮ বার। ব্যাট হাতে সাদা পোশাকে করেছেন ২ ফিফটিও। ২০ ওয়ানডেতে ৪.৯৪ ইকোনমিতে শিকার করেছেন ১৭ উইকেট। এছাড়া ২ টি-টোয়েন্টিতে ৭.২৫ ইকোনমিতে শিকার করেছেন ২ উইকেট। অপরদিকে, ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের ঝুলিতে পুরেছেন ৮৩১ উইকেট।