বদ্রিনাথ-কোহলি ও চাকরি খোয়ানো ভেঙসরকার

উপমহাদেশের ক্রিকেটে স্বজনপ্রীতি নতুন কোনো ব্যাপার নয়। যুগ যুগ ধরে এই ব্যাপারটা চলে এসেছে। আর বিশেষ করে ভারতীয় ক্রিকেটে এর প্রভাব বেশি।

উপমহাদেশের ক্রিকেটে স্বজনপ্রীতি নতুন কোনো ব্যাপার নয়। যুগ যুগ ধরে এই ব্যাপারটা চলে এসেছে। আর বিশেষ করে ভারতীয় ক্রিকেটে এর প্রভাব বেশি।

সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক দিলীপ ভেঙসরকার ২০১৮ সালে মুখ খুলেছিলেন এই স্বজনপ্রীতির প্রসঙ্গে। আর তাতেই বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এক ঘটনা।

দিলীপ যা বলেছিলেন, তার সারমর্ম হল ২০০৮ সালে বিরাট কোহলিকে দলে নেওয়ার কারণেই চাকরি হারাতে হয়েছিল বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) সাবেক এই নির্বাচককে। ওই সময় সুব্রানিয়াম বদ্রিনাথের চেয়ে বিরাট কোহলিকে খেলানোই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করছিলেন ভেংসরকার। আর সেটাই কাল হয় তাঁর জন্য।

বিষয়টাতে মনোক্ষুণ্ন হয়েছিলেন তখনকার সময়ে বোর্ডের কোধাধক্ষ্যের দায়িত্ব পালন করা এন শ্রীনিবাসন। আর এরই ধারাবাহিকতায় চাকরি হারান সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার। মুম্বাইয়ের এক মনোরম অনুষ্ঠানে এই ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করেছিলেন ভেংসরকার। আর তাতেই বেরিয়ে আসে এক অন্ধকার অধ্যায়।

২০০৮ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিরাট কোহলি। সেবারই ভারতের শ্রীলঙ্কা সফরের দলে ওয়ানডে স্কোয়ারে রাখা হয়েছিল কোহলিকে। ভেঙসরকার জানান, তাঁকে নিয়ে নির্বাচক কমিটির সবাই খুব মুগ্ধ ছিল। তাঁদের মনে হচ্ছিল, তখনই বিরাটের অভিষেক করিয়ে দেওয়া দরকার। তবে, মজার ব্যাপার হল সেই সিদ্ধান্তটা ঠিক পছন্দ হয়নি তখনকার অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি কিংবা কোচ গ্যারি কার্স্টেনের।

এন শ্রীনিবাসন, তখন ছিলেন বিসিসিআইয়ের প্রধান

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করেছিলেন কোহলিকে জাতীয় দলে নেওয়ার এটাই আদর্শ সময়। যদিও, বাকি চার নির্বাচক আমার সাথে একমত পোষণ করেছিলে, গ্যারি কার্স্টেন ও এমএস ধোনি একটু ক্ষিপ্ত ছিলেন, কারণ ওদের কোহলির ব্যাপারে খুব একটা জানা ছিল না।’

ধোনি-কার্স্টেনের চোখ ছিল সুব্রানিয়াম বদ্রিনাথের দিকে। ভেঙসরকার বলেন, ‘আমি জানতাম ওরা এস বদ্রিনাথের দিকে চোখ রাখছে। ও ছিল চেন্নাই সুপার কিংসের ক্রিকেটার। ফলে, ওর ব্যাপারে ধোনির জানাশোনা, বোঝাপড়া ভাল ছিল। ও জানতো, যদি কোহলিকে নেওয়া হয় তাহলে বদ্রিনাথকে সরিয়ে দেওয়া হবে। ওই সময় এন শ্রীনিবাসন ছিলেন বিসিসিআইয়ের কোষাদক্ষ্য। তিনিও বিষয়টা পছন্দ করেননি। কারণ ও ছিল তাঁর দলের খেলোয়াড়।’

বিসিসিআই ও আইসিসির বিতাড়িত সভাপতি শ্রীনিবাসন হলেন ইন্ডিয়ান সিমেন্টের মালিক। আর এই ইন্ডিয়ান সিমেন্টের দলই হল চেন্নাই সুপার কিংস। আর শ্রীনিবাসন ছিরেন তামিল নাড়ু থেকে বিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি, বদ্রিনাথও তামিল নাড়ুর ক্রিকেটার। ফলে, তাঁর প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব শ্রীনিবাসনের ছিল।

ভারতের হয়ে ১১৬ টি টেস্ট ও ১২৯ টি ওয়ানডে খেলা ভেংসরকার ২০০৬ সালের কিরন মোরের কাছ থেকে বিসিসিআইয়ের প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে, দুই বছরের মাথায় তিনি জায়গা হারান তাঁরই সাবেক সতীর্থ কৃষ শ্রীকান্তের কাছে। আর এর পেছনে শ্রীনিবাসনের হাত আছে বলে মনে করেন ভেঙসরকার।

২০০৮ সালের সেই শ্রীলঙ্কা সফরে অবশ্য বদ্রিনাথ ও কোহলি – দু’জনই ছিলেন। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অভিষেক হয় বদ্রিনাথের। তাতে প্রথম ম্যাচে ২৭ রানে অপরাজিত থাকলেও পরের দু’টি ম্যাচে তিনি করেন মাত্র ১২ রান। বিরাট কোহলি পাঁচটি ওয়ানডের সবগুলোতেই খেলেন। করেছিলেন যথাক্রমে ১২, ৩৭, ২৫, ৫৪ ও ৩১ রান।

সেই সিরিজের পর শ্রীনিবাসন ডেকে পাঠিয়েছিলেন ভেঙসরকারকে। ভেঙসরকার বলেন, ‘তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিসের ভিত্তিতে বদ্রিনাথকে বাদ দেওয়া হল। আমি তাকে বুঝিয়েছিলাম, বিরাট অন্যরকম একজন খেলোয়াড়। তরুণ ক্রিকেটারদের অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে ওকে আমি দেখে আসছি। আমার উত্তর পছন্দ হয়নি শ্রীনিবাসনের। তিনি বললেন, বদ্রিনাথ তো তামিল নাড়ুর হয়ে ৮০০ রান করে এসেছে। আমি বলেছিলাম, বদ্রিনাথও এক সময় সুযোগ পাবে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন, আর কবে সুযোগ পাবে? এখনই তো ওর বয়স ২৯! আমি শুধু বলেছিলাম, সুযোগ অবশ্যই পাবে, কখন সেটা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।’

সেটাই ছিল নির্বাচক হিসেবে ভেঙসরকারের শেষ দিন। তিনি বলেন, ‘এরপর দিনই ও শ্রীকান্তকে বিসিসিআই সভাপতি শরদ পাওয়ারের কাছে নিয়ে যায়, আর আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আর এরই মধ্য দিয়ে নির্বাচক হিসেবে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়।’

সেই বিরাট কোহলি গোটা ক্রিকেট বিশ্বেই এক মহীরূহের নাম। একের পর এক রেকর্ড ভেঙে চলে তিনি নিসন্দেহে এখন ক্রিকেটের সেরা তারকাদের একজন। সেদিন জহুরী ভেঙসরকার রত্ন চিনতে ভুল করেননি।

সুব্রানিয়াম বদ্রিনাথ

হ্যাঁ, বদ্রিনাথ আবারও সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০১১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চার ওয়ানডেতে খেলে করেছিলেন মাত্র ৪০ রান। এর আগে ২০১০ সালে দু’টো টেস্টও খেলেছিলেন। দু’টোই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। আর সাদা পোশাকে ওয়ানডের মত এতটাও ব্যর্থ ছিলেন না। তিন ইনিংস খেলে একটা হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, আদৌ কখনো পূর্ণতা পায়নি বদ্রিনাথের ক্যারিয়ার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link