এক যে ছিল রাজা

১৯৩৬ সালের জুলাই মাসের কথা, থার্ড রাইখের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে এক উন্মাদ একটা দেশের আহত সম্মানকে সম্পদ করে নেমে পড়েছে সাদা চামড়ার গৌরব গাথা লেখার জন্য, তা প্রায় বছর তিনেক হল। সেই উপলক্ষ্যেই বার্লিন অলিম্পিক্স।

জাহাজ থেকে নামার পরেই চোখে পড়ার মতো করে জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের পোস্টার, পদে পদে। সেই সঙ্গে রয়েছে ভিন বর্ণের এবং ভিন জাতির জন্য উপহাসনামার উপন্যাস। জেমস ক্লিভল্যান্ড ওয়েন্স। ভদ্রলোকের নাম। ডিসেম্বর ১৯৩৫এ ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালার্ড পিপলের সাধারণ সম্পাদক ওয়াল্টার ফ্রান্সিস হোয়াইট একটা চিঠি লিখে রেখেছিলেন ওয়েন্সের জন্য, জেসি ওয়েন্সের জন্য। কেন কৃষ্ণাঙ্গ বা অশ্বেতকায়দের বার্লিন অলিম্পিক্সে অংশ নেওয়া উচিৎ নয় বলে। আসলে বর্ণবিদ্বেষ প্রচার করার জন্য যে আয়োজন, সেখানে বিশ্বের সেরা অ্যাথলিটদের অংশগ্রহণে শোষকের উত্থিত হাতই পুষ্ট হয় এই ছিল বয়ান। কিন্তু চিঠিটা পাঠানো হয়নি।

আর হয়নি বলেই, মানব ইতিহাসে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এক কড়া চাবুক হিসাবে জ্বলজ্বল করতে থাকে জেসি ওয়েন্সের চারটি সোনা, অলিম্পিক্স অ্যাথলেটিক্সে। বার্লিনে, ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪x৪০০ মিটার রিলে এবং লঙ জাম্পে। পরবর্তী কালে কালো মানুষের লড়াইয়ের এক উজ্জ্বল সিম্বল হয়ে রয়ে গেছে যা।

কিন্তু আমাদের গল্পের নায়ক তো জেসি ওয়েন্স নন। অবশ্য এই গল্পের যিনি নায়ক তাঁকে আক্ষরিক অর্থে নায়ক বলা যায় কি না তা জানা নেই। যদিও তিনি কৃষ্ণাঙ্গ এবং সফল। তবুও জনপ্রিয় নন। কিছুটা ইগো এবং কিছুটা হামবড়াই ভাবের জন্য বলা যেতে পারে। তবু তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। এক স্প্রিন্টারের স্বপ্ন, এক লঙ জাম্পারের স্বপ্ন। আদতে স্প্রিন্ট এবং লঙ জাম্প দুটো আলাদা আলাদা ব্যাপার। একটায় যত দ্রুত সম্ভব দৌড়তে হবে আর আরেকটায় যত দূরে লাফ দিয়ে যাওয়া যায়। ওয়েন্স এই দুটোকেই মিলিয়েছিলেন গতি দিয়ে। আমাদের গল্পের নায়কের ক্ষেত্রে কিন্তু গল্পটা অন্য।

ছেলেবেলা থেকেই এক অদ্ভুত খামখেয়ালি চরিত্র যিনি, ফ্রেডরিক কার্লটন লুইস। জন্ম এক ক্রীড়া পরিবারে, মা হার্ডলার ছিলেন। বাবা অ্যাথলেটিক কোচ। দাদা খেলেছেন প্রফেশনাল ফুটবল। এ ছেলের পেশাদার খেলোয়াড় ছিল সময়ের অপেক্ষা। কম বয়সেই লম্বা লম্বা হাত পায়ের কারণে কার্লের বাবা ছেলেকে লঙ জাম্পে মন দিতে বললেন। আর এখানেই শুরু হল মজাটা। কার্লের বাবা দেখেছিলেন, লঙ জাম্পারদের রানআপ স্মুথ না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে শরীরের উর্দ্ধভাগের যথেষ্ট জোর থাকা সত্ত্বেও লাফেয় সমস্ত শক্তি নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। লংজাম্প আরও ভালো করার জন্য ছেলেকে পরামর্শ দেন স্প্রিন্টিং-এ নামতে। আর সেখান থেকেই স্বপ্ন বোনা।

কার্ল স্প্রিন্টে আসেন লঙ জাম্পের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফলে ১০০ বা ২০০ মিটারের শেষের দিকে গতি কমে যেত না। সাধারণত স্প্রিন্টারদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাঁরা প্রথম ষাট মিটারে যতটা শক্তি প্রয়োগ করে গতি বাড়াতে পারছেন, শেষ চল্লিশ মিটারে তা ধরে রাখা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে দমে টান পড়ার জন্য। কিন্তু লুইস তো স্প্রিন্টে এসেইছেন এই দমে ঘাটতি হয়ে লঙ জাম্পের লাফের আগের মুহূর্তে যাতে গতি কমে না যায়, রানআপ সাবলীল থাকে তাই জন্য। সেই জন্যই তো আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

ফলস্বরূপ লংলজাম্পের টেকনিকে পরিবর্তন এল। আর স্প্রিন্টে শেষমুহূর্তে গতিমন্থরতার সঙ্গেও যোঝা গেল।

শুরুতে ১৯৩৬এর বার্লিন অলিম্পিক্সের গল্প বলেছিলাম। যা এক রক্তক্ষয়ী রাজনীতির উত্থিত চিহ্ন হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এখন আরেক অলিম্পিক্সের কথা বলা হবে যার সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। অবশ্য রাজনীতি এর আগের অলিম্পিক্সে বেশি হয়েছিল, এবারে তো শুধু বদলা। ১৯৮০র অলিম্পিকে লুইসের নামা হয়নি। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ‘আগ্রাসন’-এর প্রতিবাদে কার্টারের অ্যামেরিকার নেতৃত্বে ৬৫টি দেশ অংশ নিতে অস্বীকার করে। তার প্রতিশোধ হিসাবে ১৯৮৪র লস এঞ্জেলস অলিম্পিক্সে সোভিয়েত ব্লকের কেউই এল না। কিন্তু তা বলে কি লুইসের কৃতিত্ব ছোট হয়ে যাবে?

চারটে সোনা তো দূরের কথা, স্প্রিন্ট এবং লঙ জাম্প ডবলের কথাই কেউ ভাবেননি। লুইসের ক্ষেত্রে সুবিধা ছিল, লংজাম্পে উন্নতির জন্য স্প্রিন্টে আসা এবং লঙজাম্প দিতে পারার কারণে স্প্রিন্টে সুবিধা। ওয়েন্সের গল্পটাও সেরকম। ওয়েন্সের সামনে তবু একটা উদাহরণ ছিল, ডি’হার্ট হুবার্ড কলেজ স্তরে ১৯২৫এ এরকম একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। যদিও ১৯২৪এ লঙ জাম্পে অংশ নিয়ে শুধু সোনা জেতার রেকর্ড আছে তাঁর, কিন্তু লুইস? তবু লুইস নামলেন। কারণ ইতিহাস গড়া তো তাঁর ভবিতব্য ছিল। জিতলেনও, জেসি ওয়েন্সের পর দ্বিতীয় অ্যাথলিট হিসাবে চারটি সোনা, মাত্র ২৩ বছর বয়সে।

হিসাব মতো এরপরের সবকিছু তো একদম রূপকথার মতো হওয়ার কথা। বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সের বিশেষত আধুনিক অ্যাথলেটিক্সের এক প্রডিজাল পুরুষ। কিন্তু তাই কি হল? ‘৮৪তে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন, কিন্তু ‘৮৬র গুডউইল গেমসে হারালেন লুইসকে। আর ’৮৭ সালের রোম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তো বিশ্বরেকর্ড আর কার্ল লুইসের সমস্ত অর্জিত খ্যাতিকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে জিতলেন ১০০ মিটারে কানাডার বেন জনসন। স্প্রিন্টে লুইসের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া শুরু।

লুইস কি আসতে পারবেন ফিরে আর?

এসে গেল ’৮৮-এর সিওল। ‘৮৭তে শুধু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ নয়, লুইস হারিয়েছেন তাঁর বাবাকেও। বাবার সঙ্গেই কবর দিয়েছেন ’৮৪-এর অলিম্পিক্সের ১০০ মিটারের সোনার মেডেল। মা’কে ভরসা দিয়েছেন যে আরেকটা নিয়ে আসবেন তিনি, সিওলের অলিম্পিক স্টেডিয়াম থেকে। কিন্তু অতই কি সোজা? কানাডার লাল রঙকে ভেস্ট এবং শর্টসে জড়িয়ে আছেন বেন জনসন, আছেন ব্রিটেনের নীল সাদা লালে লিনফোর্ড ক্রিস্টি।

সকলেই উৎকণ্ঠিত, ফটাস করে স্টার্টারের বন্দুক আওয়াজ তুলল আর চোখের পলক পড়তে না পড়তে উড়ে গেলে বেন জনসন, ৯.৭৯ সেকেন্ড। নতুন বিশ্ব রেকর্ড। লাল চোখে জনসন তাকালেন না কারুর দিকে, স্টেডিয়ামেও থাকলেন না বেশিক্ষণ। যেন এসেছিলেন জিততে, জিতে বেরিয়ে গেছেন আর কী! ২০০ মিটার ফাইনালও হারলেন লুইস অলিম্পিক রেকর্ড খুইয়ে। ৪x১০০ মিটারেও হিটেই লুইসের সতীর্থরা ব্যাটন বদলাতে গিয়ে হাতছাড়া করে ডিস্কোয়ালিফায়েড হলেন।

সবেধন নীলমণি লঙ জাম্পের সোনা। কিন্তু গল্পের গরু গাছ থেকে নেমে সিওলের রাস্তায় ঘুরে চলে এল সাংবাদিক সম্মেলনে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি এক চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক সম্মেলনে জানাল অ্যানাবলিক স্টেরয়েড নিয়ে ওইরকম দানবীয় পারফরম্যান্স জনসনের। ছিনিয়ে নেওয়া হল সোনা জনসনের থেকে। লুইসে ৯.৯৩ পেল সোনা, পরপর দু বার। এই শেষ নয়, তদন্তে স্বীকার করলেন বেন যে বহুদিন ধরে এই পারফরম্যান্স বৃদ্ধিকারী ড্রাগস সেবন করছেন তিনি। ফলস্বরূপ ’৮৭র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের সোনাও দেওয়া হল জনসনের থেকে ছিনিয়ে কার্লকে। কিং কার্ল। তাঁর আগে কেউ ১০০ মিটারে অথবা লঙ জাম্পে অলিম্পিক সোনা একাধিকবার পাননি। কার্ল পরপর দু’বার পেলেন। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপেও তাহলে ডবল হল।

এখানেই তো গল্প শেষ হতে পারত। যে কাজ কেউ আজ পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি। ছ ফুট দু ইঞ্চির বার্মিংহ্যাম, অ্যালাবামার সন্তানের অমরত্ব লাভের জন্য এর বেশি কিছু করার দরকার ছিল না হয়তো। কিন্তু আমাদের গল্প তো আরও তিন বছর পরের। টোকিও, তৃতীয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পটভূমি। কিং কার্ল দুবারের ১০০ মিটার ও লংজাম্প বিজেতা। তৃতীয়বারের লঙ জাম্প নিয়ে তো চিন্তা নেই। কিন্তু ১০০ মিটারে তাঁর আধিপত্য প্রশ্নের মুখে।

সান্টা মনিকা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ক্লাবের তাঁরই সতীর্থ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু লেরয় বারেল ক’দিন আগেই ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপে কার্লকে শুধু হারানইনি, সঙ্গে তাঁর বিশ্ব রেকর্ড ছিনিয়ে নিয়েছেন, ৯.৯০ সেকেন্ড। ১০০ মিটারের দৌড়ে লেরয়ই ফেভারিট। দুজনের টেকনিকের ফারাক আছে। লেরয় প্রথাগত স্প্রিন্টারদের মতো শরীরের উর্দ্ধভাগের শক্তিতে স্টার্ট থেকেই ছিটকে বেরোন তুমুল গতিতে। আর কার্ল উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে লঙ জাম্পের অভিজ্ঞতায় শেষ চল্লিশ মিটার নিজের গতিবেগ বজায় রাখেন।

রবিবার, ২৫ আগস্ট ১০০ মিটারের ফাইনালের জন্য নির্দিষ্ট। ফাইনালের আটজনের ফিল্ড এবারে চরম উত্তেজক। কোয়ার্টারফাইনালেই লুইস বাতাসের সহায়তা নিয়ে ৯.৮০ সেকেন্ড সময় করেছেন। সেমি ফাইনালে ৯.৯৩। বারেলও পিছিয়ে নেই, নিজের সেমি ফাইনালে ৯.৯৪ সেকেন্ড সময় করে ফাইনালের শো ডাউনের জন্য তৈরি। সঙ্গে রয়েছেন ব্রিটেনের লিনফোর্ড ক্রিস্টি, নামিবিয়ার ফ্র্যাঙ্কি ফ্রেডরিক্স, জামাইকার রে স্টুয়ার্ট, কানাডার ব্রুনি সুরিন, ব্রাজিলের রবসন দ্য সিল্ভা এবং লুইসদের সতীর্থ ডেনিস মিচেল।

শটগানের আওয়াজে ছিলার মতো ছিটকে বেরলেন ডেনিস মিচেল। তদানীন্তন বিশ্বের ১ নম্বর ১০০ মিটার স্প্রিন্টার বিশ্বরেকর্ডধারী বারেল চল্লিশ মিটারে ধরে ফেলে এগোতে শুরু করলেন, ঠিক পিছনেই লিনফোর্ড ক্রিস্টি। আর মাত্র ২০ মিটার, ব্লক থেকে বেরোনোর ১০ মিটার পরেও যিনি ছয় নম্বরে সেই লুইস, ফ্রেডরিক কার্লটন লুইস। দুপায়ের হাঁটু দুটো মুড়ে নিজের বুকের সামনে তুলতে লাগলেন যেন হুলের দামামা বেজেছে।

১০ মিটার, শুধু বারেল আর লুইস। এক দুই, এক দুই, এক দুই, ফিতে এসে চলে গেল। লুইস তিন নম্বর লেনের দিকে তাকিয়ে দু’হাত উপরে তুলে দিলেন উল্লাসে। ৯.৮৬ সেকেন্ডের বিশ্বরেকর্ড চলে গেল লুইসের দখলে। শেষবারের মতো, কিন্তু বাজীমাত করলেন লুইস। আর বারেল? সতীর্থের অসম্ভব প্রতিভা আর অদম্য জেদের কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া তাঁর কিছু করার ছিল না। কার্ল লুইস এক অদ্ভুত এনিগমার নাম, কখনও না হেরে যাওয়া এক অদম্য প্রতিভার নাম।

কিন্তু এর চারদিনের মধ্যেই পৃথিবীর রঙ পালটে গেল। লংজাম্পে লুইস দশ বছর হারেননি। দুবারের অলিম্পিক এবং দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের সোনা জিতেছেন তিনি। তবু বব বিমন অধরা তাঁর কাছে। বব বিমন। মেক্সিকোর এস্তাদিও অলিম্পিকো ইউনিভার্সিতারিও, ১৮ই অক্টোবর ১৯৬৮। বব বিমন আগের বিশ্ব রেকর্ডের থেকে প্রায় ৫৫ সেন্টিমিটার বেশি লাফিয়ে ৮.৯০ মিটারের লংজাম্পের বিশ্বরেকর্ড করে সোনা জেতেন। সেই ১৯৬৮ থেকে সুদীর্ঘ ২৩ বছর সেই লাফ অধরা। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা এবং ২ মিটার/ প্রতি সেকেন্ডের বাতাসের সহায়তা পেয়ে এই আইনত লাফ এক বিশাল পাহাড়ের মতো এতদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

লাফ শুরু হল, লুইস সাংঘাতিক ফর্মে। প্রথম লাফটাই গেমস রেকর্ড ৮.৬৮ মিটার। চতুর্থ লাফে বিমনকে পেরিয়ে গেলেন লুইস। ৮.৯১ মিটার! যদিও বাতাসের গতিবেগ মান্য ২ মিটারের থেকে বেশি থাকায় রেকর্ড হিসাবে মানা হল না। তবু সদর্পে সোনার হ্যাটট্রিকের দিকে এগিয়ে চলেছেন লুইস। মাইক পাওয়েল। ১৯৮৮’র সিওল অলিম্পিক্সে রূপো পেয়েছিলেন তিনি।

এখানে চতুর্থ যে লাফটি দিলেন, সেটি লুইসের ৮.৯১-কে পেরিয়ে গেছে বোধহয়, কিন্তু মিলিমিটারের জন্য ফাউল জাম্প। পাওয়েল জাম্প পিটের কাছে বসে পড়লেন। লুইস তখন রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ। কিন্তু পাওয়েল? যেন দেবদূতের মতো উড়াল দিলেন পঞ্চম লাফে। ৮.৯৫ মিটার। বব বিমনের বিশ্বরেকর্ড ভেঙে চুরমার। চুরমার হওয়ার মুখে লুইসের দশ বছর লংজাম্পে না হারার রেকর্ড। শেষ চেষ্টা চালালেন লুইস। বাতাস মান্য ৮.৮৭ আর ৮.৮৪।

এতো কাছে গিয়েও হল না। চার দিন আগের শতাব্দীর সেরা ১০০ মিটারের বিজয়ী আরেক শতাব্দীর সেরা প্রতিযোগিতায় তুল্যমূল্য লড়াই চালালেন। কিন্তু এবার বিজয়লক্ষ্মী মাইক পাওয়েলের জন্য বর দিয়েছেন। বাজিমাত করে চলে গেলেন অন্য কেউ।

এর পরেই ১৯৯২’র অলিম্পিক। লুইসের বদলা নেবার মঞ্চ। কিন্তু ইউএস অলিম্পিক ট্রায়ালে ১০০ এবং ২০০ মিটারে চতুর্থ হয়ে ব্যক্তিগত ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হারালেন। বার্সিলোনায় যদিও ৪x১০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ড করা ইউএস দলের অ্যাঙ্কর লেগ দৌড়লেন তিনি, তবুও যেন স্প্রিন্ট ইভেন্টে বয়স থাবা বসাতে শুরু করেছে। তবু বদলা এল।

নিম্নমানের এক প্রতিযোগিতায় লংজাম্পে প্রথম রাউণ্ডের ৮.৬৭ মিটারেই সোনা পেলেন তিনি, পাওয়েল অনেক চেষ্টা করেও শেষ লাফে ৮.৬৪ মিটারে রূপো। অলিম্পিকের ইতিহাসে কেউ পরপর দুই অলিম্পিকে লংজাম্পে সোনা পাননি। লুইস সেখানে হ্যাটট্রিক করলেন।

পরের বছরগুলো চোট আঘাত আর বয়স থাবা বসালেও আবার ১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিক্সে সোনা এল লংজাম্পে। পরপর চারবার। এর আগে অ্যামেরিকার অ্যাল অর্টার একমাত্র ডিসকাসে পরপর চারবার সোনা পেয়েছিলেন। অ্যাথলেটিক্সে সেই রেকর্ড অধরা থেকে গেছে। লুইস লঙ জাম্পের সোনা নিয়ে আটলান্টায় মোট নটি সোনা নিয়ে ফিনল্যান্ডের দৌড়বিদ প্যাভো নুর্মি, সোভিয়েত জিমনাস্ট ল্যারিসা লেটনিনা ও ইউএস সাঁতারু মার্ক স্পিৎজের রেকর্ড স্পর্শ করেন। একটা সুযোগ এসেছিল, দশ নম্বর সোনার।

৪x১০০ মিটারে অংশ নিয়ে যদি করতে পারতেন। কিন্তু লুইস রিলে প্র্যাকটিসে নামেননি এবং অ্যাঙ্কর লেগ দৌড়তে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ইউএস অ্যাথলেটিক্স চিরকাল ব্যক্তির থেকে ফর্ম ও সিস্টেমকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তাই লুইসের আর দশম সোনা পাওয়া হয়নি। পরে অবশ্য আরেক অ্যামেরিকান সাঁতারু মাইকেল ফেল্পস সকলের রেকর্ড ভেঙে দেন। তবে সে অন্য গল্প।

১৯৯৭ সালে লুইস ট্রাক ও ফিল্ডকে বিদায় জানান। কার্ল লুইস, এক যুগান্তকারী অ্যাথলেট। যদিও জনপ্রিয় কোনোকালেই ছিলেন না তাঁর ব্যবহার এবং অ্যাটিচিউডের জন্য। তবুও বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে লুইসের অবদানের কথা ভোলার নয়। পরবর্তীকালে তাঁর নামেও ডোপিং-এর অভিযোগ আসে এবং প্রমাণাভাবে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু যে সময় ফ্লোরেন্স গ্রিফিত জয়নারের আকস্মিক মৃত্যু এবং বেন জনসনের ডোপিং অ্যথলেটিক্সকে অবিশ্বাএর কালো অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিল তখন লুইস, সার্গেই বুবকা, মাইকেল জনসন, এড মোজেসরা পুরুষ অ্যাথলেটিক্সকে তাঁর গুণমান বজায় রেখে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে উসাইন বোল্টরা সেই ব্যাটন নিয়েই আরও আরও এগিয়ে চলে গেছেন বিদ্যুন্মালার কাছাকাছি।

কার্ল লুইস, আমার জীবনের প্রথম অলিম্পিক হিরো, পিটি ঊষা এবং জ্যাকই জয়নার কার্সির সঙ্গে। শুধু উৎকর্ষই নয় দীর্ঘ দিন ধরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে হার না মানা জেদ এবং প্রতিরোধ ডিঙিয়ে জেতার ক্ষমতা মনের মণিকোঠায় কার্লের জায়গা অমর করে রেখেছে। স্প্রিন্টে শেষ কুড়ি মিটার গতি ধরে রেখে হাঁটু দুটো সমানে পিস্টনের মতো বুকের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া বা লংজাম্পে স্প্রিন্টের টেকনিকে সাইকেল চালানোর মতো করে লাফ।

কার্ল লুইস, কিং কার্ল। গত শতাব্দীর সেরা অ্যাথলেট। জনপ্রিয়তম না হলেও সেই শিরোপা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না তাঁর থেকে। ঘাম রক্ত দিয়ে প্রতিভাকে কষ্টিপাথরে ঘষে যা যাচাই করা হয়ে গেছে মহাকালের ট্রাক ও ফিল্ডে।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link