২০০২ সালের ১৩ জুলাই। ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল ভারত। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড গড়েছিল ৩২৫ রানের পাহাড়। আজকের এই দিনে হয়তো ৩২৫ রানকে খুব বেশি মনে না হতে পারে, তবে ২০ বছর আগের সময়ে ৩০০ রানের ইনিংস-ই দেখা যেত কদাচিৎ। তার উপর উপমহাদেশের একটি দলের জন্য ইংল্যান্ডের মাঠে এই রান তাড়া করে জেতা প্রায় অসম্ভব।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য শেষ হাসি হাসে ভারত। মোহাম্মদ কাইফের দৃঢ়তায় অসম্ভবকে সম্ভব করে দুই উইকেটের নাটকীয় জয় পায় তারা। কিন্তু ম্যাচের নায়কদের ছাপিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল অন্য কিছু, লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি হাওয়াতে দুলানো উন্মত্ত এক উদযাপন।
ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়কের স্বভাববিরুদ্ধ এক মুহুর্ত। যা আজও শিহরণ জাগায় অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর মনে। উদযাপনটি ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের, ভক্তরা যাকে ভালবেসে দাদা বলে ডাকে।
বাংলার হয়ে রঞ্জি টূর্নামেন্টে অভিষেক হয়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলির। বয়স ভিত্তিক দল আর ঘরোয়া আসরগুলোতে শুরু থেকেই নিজের প্রতিভার ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আর তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডাক পেতে সময় লাগেনি তাঁর।
কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শুরুটা একেবারেই মনের মত হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে দু:স্বপ্নের সেই ম্যাচে মাত্র ৩ রানেই ড্রেসিং রুমে ফিরতে হয়েছিল তাকে। এরপর গাঙ্গুলির বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছিল। সবমিলিয়ে যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। অভিযোগ অস্বীকার করলেও ভারতীয় ক্রিকেট দল থেকে বাদ পড়তে হয় তাকে।
দীর্ঘ বিরতি শেষে রঞ্জি ট্রফিতে রান বন্যা সৃষ্টি করে পুনরায় নির্বাচকদের মন জয় করতে সক্ষম হন তিনি। ১৯৯৬ সালের ইংল্যান্ড সফরে দলে জায়গা পান। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে নিজের অভিষেক ক্যাপ পেয়ে যান কলকাতার ছেলে। অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি করে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখান তিনি।
তার ১৩১ রানের ঝলমলে ইনিংসে ভর করে ম্যাচটি ড্র করতে সক্ষম হয় ভারত। পরের ম্যাচে আবার ট্রেন্ট ব্রিজে সৌরভের ব্যাট থেকে এসেছে ১৩৬ রানের আরেকটি দুর্দান্ত ইনিংস। গাঙ্গুলির জন্য সে সিরিজটি ছিল রূপকথার মতো। অবশ্য টেস্টে স্মরনীয় ইনিংস খেলা হলেও একদিনের ফরম্যাটে বড় রান পেতে গাঙ্গুলিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বেশ কিছু দিন।
শেষপর্যন্ত ১৯৯৭ সালে শ্রীলংকা সফরে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। একই বছরের শেষদিকে পাকিস্তানের সাথে সাহারা কাপে টানা চার ম্যাচে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ এর পুরস্কার ওঠে তার হাতে। আর এমন অর্জন ক্রিকেটের বিরলতম কীর্তি গুলোর একটি।
অল্পের সময়ের মধ্যে নিজেকে প্রমান করেন গাঙ্গুলি, বুঝিয়ে দেন তিনি লম্বা সময় রাজত্ব করতে এসেছেন। এরপর থেকে ভারতীয় দলের টপ অর্ডার সামলানোর দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকারকে সঙ্গে নিয়ে সে দায়িত্ব বেশ ভালভাবেই পালন করেছেন তিনি। রানের হিসেবে শচীনের সাথে ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা জুটি গড়েছিলেন সৌরভ। এই দুই ব্যাটিং কিংবদন্তি মিলে করেছিলেন ৮২২৭ রান।
২০০০ সালে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগে জর্জরিত ভারতীয় দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। অধিনায়কত্ব পেয়ে আরো ক্ষুরধার হয়ে উঠেন তিনি। আইসিসির বড় টুর্নামেন্ট কিংবা বড় দলের সঙ্গে তার ব্যাটেই স্বস্তি পেয়েছিলো ভারত। সামনে থেকে নেতৃত্বে দিয়ে ২০০০ সালের আইসিসি নকআউট ট্রফির ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন টিম ইন্ডিয়াকে।
এছাড়া ২০০৩ বিশ্বকাপেও সৌরভের ব্যাটে রানের ফোয়ারা সৃষ্টি হয়। তার অসাধারণ নেতৃত্ব এবং ৫৮.১২ গড়ে ৪৬৫ রানে ভর করেই ১৯৮৩ সালের পর আরো একবার বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছায় ভারত। অবশ্য ফাইনালে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারেনি এশিয়ান পরাশক্তিরা।
অধিনায়ক থাকা অবস্থায় একাধিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সৌরভ। বোর্ডের উপর প্রভাব বিস্তার, টসের সময় দেরী করে মাঠে আসা আর লর্ডসের সেই উদ্দাম উদযাপন – এমন সব কাজের জন্য বহুমুখী সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। তবে মাঠে নিজেকে ঠিকই উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি।
ক্রমাগত ব্যর্থতা, স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি এবং হারের চক্রে ধুঁকতে থাকা ভারতীয় দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার পর শুধুই ইতিহাস রচনা করেছেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্বে বদলে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটকে। তাঁর হাত ধরেই ভারত উঠে আসে ওডিআই র্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে, টেস্টে তিনে। তৎকালীন সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের সাথে কেবল গাঙ্গুলির ভারতই প্রতিযোগিতা করতে পারতো। অধিনায়ক হিসেবে গাঙ্গুলির তুলনা আসলে তিনি নিজেই।
২০০৪ সাল পর্যন্ত অধিনায়ক হিসেবে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিলেন সৌরভ। এমনকি ইতিহাসের সবচেয়ে সফলতম অধিনায়কদের আলোচনায় উঠে আসে তাঁর নাম। এরপরই ছন্দপতন ঘটে তার ক্যারিয়ারে; ২০০৫ সালে ভারতীয় দলের হেড কোচ হয়ে আসেন গ্রেগ চ্যাপেল। সেই বছর অফ ফর্মের জন্য চ্যাপেলের পরামর্শে জাতীয় দল থেকে বাদ দেয়া হয় সৌরভকে।
পুনরায় দলে ফিরতে সৌরভকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় এক বছর। প্রত্যাবর্তনের পর নতুন করে নিজেকে প্রমান করেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং শ্রীলংকা সফরে ৭০ গড়ে রান তুলে উভয় সিরিজে ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ জিতেন; দলে আবারও নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেন।
একটানা বছর দেড়েক খেলার পরে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন সৌরভ। এর পরের বছরে সাদা পোশাকের টেস্ট থেকে অবসর নেন সৌরভ গাঙ্গুলি।
নিজের ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে ৩১১টি ওয়ানডে খেলা গাঙ্গুলি করেছেন ১১৩৬৩ রান। গড়টা চল্লিশের উপরে আর স্ট্রাইক রেট ৭৩। বাইশটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি ৭২টি হাফসেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। অন্যদিকে লাল বলে ১১৩টি ম্যাচ খেলেছেন এই ওপেনার। ৪২ গড়ে ৭২১২ রান করেছেন এই ফরম্যাটে। ৩৫টি অর্ধশতকের পাশাপাশি ১৬টি শতক রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। এই ফরম্যাটে কখনোই সৌরভের ব্যাটিং গড় চল্লিশের নিচে নামেনি৷
২০০৮ সালে ভারতীয় ক্রিকেটে সংযুক্ত হয় আইপিএল। কলকাতা নাইট রাইডার্স টিমের অধিনায়ক ঘোষিত হন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু পরের বছর আইপিএল চলাকালীন মাঝপথে অধিনায়ক পদ থেকে সৌরভকে সরিয়ে দেয় নাইট কর্তৃপক্ষ। পরে পুনে ওয়ারিওয়র্স টিমের হয়ে আইপিএল খেলেছিলেন সৌরভ।
অবসরের পর জনপ্রিয় টিভি শো দাদাগিরির হোস্ট ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি; বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বও ছিল তাঁর কাঁধে। এছাড়া ২০১৮ সালে সৌরভের আত্মজীবনী ‘আ সেঞ্চুরি ইজ নট ইনাফ’ প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য অন্যসব দায়িত্ব ছেড়ে ২০১৯ সালে ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে নিয়োজিত আছেন মহারাজা খ্যাত গাঙ্গুলি।
সৌরভ গাঙ্গুলিকে ভালোবেসে ‘প্রিন্স অব কলকাতা’ বলা হয়। নিজের ক্যারিয়ারের একটি যুগ সৌরভ গাঙ্গুলি যেভাবে নিজের সৌরভে মুগ্ধ করেছিলেন সব ক্রিকেট ভক্তকে তাতে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রিন্স বললেও অবশ্য আপত্তি করার কথা নয়।