ক্রিকেট বলে সহজাত সুইং পাওয়া বাংলাদেশের ফাস্ট বোলারদের কাছে সোনার হরিণের মত দুষ্প্রাপ্য বটে। বল দুইদিকেই সুইং করাতে পারেন, এমন একজন পেসারের খোঁজে দর্শক থেকে শুরু করে বিসিবির নির্বাচকেরা পার করেছেন অনেক দিন। অবশেষে বাংলাদেশ পেয়েছে তাদের কাঙ্ক্ষিত সুইং বোলারকে, আবু জায়েদ চৌধুরী রাহির মাঝে।
রাহি শুধু সুইং করাতেই পারেন এমনটাও নয় বরং নিয়ন্ত্রণও করতে জানেন ভাল ভাবে। বাংলাদেশ সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি তো অকপটে বলে দিয়েছেন, ‘রাহি বাংলাদেশের একমাত্র বোলার, যে বল করার আগেই বলতে পারবে এটা ইনসুইং হবে নাকি আউটসুইং।’
এই রাহীর হাত ধরেই প্রথম টেস্ট ক্রিকেটে শক্ত পেস আক্রমণের শুরু হয়। এরপর নবাগত শরীফুল, ইনজুরি থেকে ফেরা তাসকিন আহমেদ, হঠাৎ করেই ফর্মে ফেরা ইবাদত, খালেদরা যোগ দিয়েছেন পেস-বিপ্লবে। কিন্তু শুরুর পথপ্রদর্শক আবু জায়েদ রাহী-ই ধীরে ধীরে পথ হারাতে শুরু করেন।
গত দুই বছর আগেও তিনি ছিলেন একাদশের অটো চয়েজ ফাস্ট বোলার, একেবারে প্রথম পছন্দ যাকে বলে। কিন্তু তাসকিন, শরীফুলদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে একটা সময় একাদশে জায়গা হারান। একাদশে না থাকলেও অবশ্য স্কোয়াডে ছিলেন অনেকদিন কিন্তু গত শ্রীলঙ্কা সিরিজ থেকে তিনি পুরোপুরি দলের বাইরে। বলা যায়, নির্বাচকদের ভাবনার বাইরেও চলে এসেছেন সিলেটের এই পেসার।
অবশ্য এমন অনাকাঙ্খিত বাদ পড়ার যৌক্তিক কারণও আছে। আবু জায়েদের শক্তির জায়গা সুইং হলেও দুর্বলতা আছে গতিতে। আধুনিক ক্রিকেটে একজন পেসার হিসেবে যেখানে সবার লক্ষ্য থাকে ঘন্টায় ১৪০ কিমিতে বল করার সেখানে রাহীর বলের গতি ১৩০ ছুঁই ছুঁই। ধীর গতির এই ডেলিভারিগুলোতে তাই যতই সুইং দেন আবু জায়েদ রাহী, ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলার জন্য যথেষ্ট হয় না৷
পরিসংখ্যানের হিসেবে অবশ্য এখনো দেশসেরা বোলার আবু জায়েদ রাহি। এখন পর্যন্ত ১৩ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৩০ উইকেট। বোলিং গড়টা ৩৭, এদিক দিয়েও রাহী বাকিদের থেকে এগিয়ে আছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান আর অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও এখন রাহীকে বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। বরং তাসকিন, ইবাদতদের ব্যাকআপ হিসেবে স্কোয়াডে রাখা হচ্ছে তরুন শহীদুল ইসলাম আর রেজাউর রহমানকে।
অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই সুইংয়ের চেয়ে বলের গতিকে প্রাধান্য দেয়া হয় বেশি। এই যেমন, ভারতের ভুবনেশ্বর কুমার, বুমরাহ, সিরাজদের মত ১৪০/১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বল করতে পারেন না। তাই গতির ঝড়ে টেস্ট দলে জায়গা পায়না ভুবির সুইং।
এছাড়া পাকিস্তানের মোহাম্মদ আব্বাসও এই গতির কারনে পিছিয়ে আছেন সতীর্থ শাহীন শাহ আফ্রিদি এবং নাসিম শাহদের থেকে। অস্ট্রেলিয়ার চ্যাড সায়ের্স ও মাইকেল নেসারের জন্যও প্রযোজ্য একই কথা।
সবমিলিয়ে, একটা বার্তা অন্তত এতদিনে আবু জায়েদ রাহি বুঝে ফেলেছেন। বলে সুইং কিংবা নিয়ন্ত্রণ যত বেশিই থাকুক, আন্তজার্তিক ক্রিকেটে টিকে থাকার দৌড়ে তিনি এখনো পিছিয়ে আছেন। গতি, দৈহিক গঠনের দিক থেকে ইবাদত, তাসকিন এমনকি খালেদ আহমেদও অনেক এগিয়ে আছেন তার চেয়ে।
অবশ্য আবু জায়েদ চৌধুরিকে একেবারে ছুড়ে ফেলে দেয়নি বিসিবি। মিজানুর রহমান বাবুলের অধীনে রাখা হয়েছে বাংলা টাইগার্সের ক্যাম্পে। সম্প্রতি বাংলা টাইগার্স বনাম হাইপারফরমেন্স ইউনিটের মধ্যকার চারদিনের ম্যাচে দেখা গিয়েছে আবু জায়েদ রাহীকে। আর এই ম্যাচে আরো একবার পরিষ্কার হয়ে উঠেছে আবু জায়েদের বোলিংয়ের আদ্যপান্ত।
এইচপি ইউনিটের তরুন রিপন মন্ডল, মৃত্যুঞ্জয়, মুগ্ধরা একদিকে গতি আর বাউন্সে বারবার পরাস্ত করেছিলেন ব্যাটারদের। অন্যদিকে আবু জায়েদের ধীরগতির সুইংগুলো সাবলীলভাবেই সামলেছেন ব্যাটসম্যানরা। আবার অন্যদের নিঁখুত লাইন-লেন্থের বিপরীতে তাঁকে প্রায় বাজে ডেলিভারি করতে দেখা গিয়েছে। এই যে দেশের সেরা কাতারের পেসারদের সাথে রাহীর পার্থক্য সেটিই তার বাদ পড়ার মূল কারন।
আর তাই জাতীয় দলের জার্সিতে ফিরতে চাইলে ঠিক এখানটায় কাজ করতে হবে তাকে। নিজেকে ভেঙেচুরে আবার গড়তে হবে। সেক্ষেত্রে রাহীর সামনে আদর্শ হতে পারেন তাসকিন আহমেদ। একটা সময় গতিময় বোলিং করেও ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলতে পারতেন না তাসকিন, অথচ লম্বা সময় পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফেরা তাসকিনের মাঝে গতির পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে টাইট লাইন-লেন্থ আর ভ্যারিয়েশন।
সহজ ভাষায় বললে, নিজের শক্তিমত্তার জায়গা ধরে রেখে বলে আরো পাঁচ-সাত কিংবা দশ কিমি গতি বাড়াতে পারলে হয়তো ব্যাটসম্যানদের পরাস্ত করতে সক্ষম হবেন এই ডানহাতি ফাস্ট বোলার। আর তা নাহলে দলে ফেরাটা তার জন্য প্রায় অসম্ভব বটে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাদ পড়ার পরে গণমাধ্যমে বেশকিছু বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন আবু জায়েদ রাহী। বাদ পড়ার পিছনে পারফরম্যান্সের চেয়ে অন্য কারন আছে বলেই ক্ষোভ ঝেড়েছেন তিনি। তবে এসবে লাভ হয় নি, হওয়ার কথাও না। রাহীর সামনে এখন একটাই পথ খোলা, সেটা প্রত্যাবর্তন।
২০১৮ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথম ম্যাচে অভিষিক্ত আবু জায়েদের সিম, সুইং ও নিয়ন্ত্রণ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার ইয়ান বিশপ। ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে রাহীকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন বাংলাদেশের জন্য দারুণ এক সম্ভাবনা। চার বছর পর এখন সেই সম্ভাবনা নিভু নিভু হয়ে কোনো রকমে টিকে আছে।
এই প্রদীপশিখাকে আবারো স্বরূপে ফেরানোর চাবিকাঠি এখন রাহীর হাতেই। দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে লড়াই চালিয়ে গেলে হয়তো তাসকিনের মতই রাহী ২.০ কে পাওয়া যাবে বাংলাদেশ দলে। সিলেটের এই পেসারের ভেতরে তাসকিনের মত সেই জেদটা আছে তো? নাকি একটাসময় পুরোপুরি আড়ালে চলে যাবেন রাহী – উত্তরের জন্য আপাতত অপেক্ষায় থাকা যাক।