ঢাকায় হারানো সেই ছেলেটি

একুশ বছর পিছনে যাওয়া যাক।

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম; ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। তখনকার দিনে এদেশে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানেই টানটান উত্তেজনা। প্রিয় দলকে সমর্থন দিতে গোটা বাংলাদেশের দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়া। খেলোয়াড় থেকে শুরু করে টিম ম্যানেজমেন্ট, সমর্থক সবার মধ্যেই যুদ্ধংদেহী মনোভাব। আর দশটা আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের মতোই স্বাভাবিক দৈরথ ছিল ঐদিনের ঐ ম্যাচেও।

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করছিল মোহামেডান। আবাহনী অধিনায়ক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর টুটি চেপে ধরতে আক্রমণাত্মক ফিল্ডিংয়ের অংশ হিসেবেই ফিল্ডার আনলেন ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে। চির অভ্যাসবশত ফিল্ডার এবারও হেলমেটবিহীন। যদিও সতীর্থদের হেলমেট পরার অনুরোধকে তিনি পাত্তা দেননি। এই অভ্যাসের দাস হওয়াটাই কাল হলো তার জীবনে।

আবাহনীর বাঁহাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ খানের খাটো লেংথের বলকে সজোরে পুল করেছিলেন মোহামেডানের ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেন। বল গিয়ে আঘাত করে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে হেলমেটবিহীন দাঁড়ানো রমন লাম্বার বাঁ কানের পাশে। আঘাতের তীব্রতা এতো বেশি ছিল যে বল লম্বাকে আঘাত করার পরেও হাওয়ায় ভেসে থাকে কিছুক্ষণ, পরবর্তীতে বাঁদিকে সরে এসে যেটিকে ক্যাচে পরিণত করেছিলেন উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলট।

রমন লাম্বার আঘাতটা কতটা গুরুতর ছিল তা অনুধাবন করা যায়নি প্রাথমিক অবস্থায়। পিচের পাশে লুটিয়ে পড়া লম্বা নিজেই উঠে দাঁড়ান, আশ্বস্ত করেন সতীর্থদের। হেঁটে হেঁটেই মাঠ ছাড়েন আবাহনীর চিকিৎসক ডা. জাওয়াদের কাঁধে ভর করে। যতক্ষণে তাকে ধানমন্ডির ডেল্টা হাসপাতালে নেয়া হয় ততক্ষণে লাম্বা গভীরভাবে অচেতন। মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার প্রভাবে কোমায় চলে গিয়েছিলেন। পরেরদিন সন্ধ্যায় সেখান থেকে রমন লাম্বাকে নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন পি জি হাসপাতাল) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে।

চিকিৎসার জন্য দিল্লি থেকে উড়িয়ে আনা হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এসেছিলেন তার পরিবারের সদস্যরাও। অবশেষে ২৩ ফেব্রুয়ারি ডাক্তারদের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে লম্বা অন্তিম পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন জগতের ঘোরতর রহস্যময় অন্য এক ভুবনে। যার স্মৃতিচারণে স্ত্রী কিম বলেছিলেন, ‘ক্ষতটা খুব গভীর, শূন্যতা বিশাল।’

ঢাকায় এভাবে প্রাণ হারানো সেই রমন লাম্বা একসময় ছিলেন ভারতীয় দলের প্রতিশ্রুতিশীল অলরাউন্ডার। এই মানুষটার জন্মদিনে এ কথাটা অন্তত বলা যায়, ক্রিকেট মাঠ দূর্ঘটনায় এক অসাধারণ প্রতিভার প্রয়ান দেখেছিলো।

পরবর্তীতে এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখা আবাহনীর অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বলেছিলেন, ‘আমি তাকে বারবার হেলমেট পরার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তাতে কোন ভ্রক্ষেপ না করা লাম্বার জবাব ছিল, ‘আরে ইয়ার অনলি ওয়ান বল!’

লাম্বার মৃত্যু শুধু একটি মর্মান্তিক ঘটনাই নয়, ছিল এক কঠোর সতর্কবার্তাও। আটত্রিশেই এভাবে খেলার মাঠে জীবন দিয়ে লম্বা এটাও প্রমাণ করে গিয়েছিলেন ক্রিকেটতো স্রেফ এক বলেরই খেলা। অন্য ভুবনের বাসিন্দা হয়ে গেলেও লম্বা এখনো সতেজ, সজীব ক্রিকেট ভক্তদের মনে। এখনো কোথাও কেউ খেলার মাঠে মাথায় আঘাত পেলেই প্রসঙ্গক্রমে আসে রমন লাম্বার স্মৃতিচারণ।

ভারতীয় জাতীয় দলের হয়ে চারটি টেস্ট আর ৩২টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা রমন লাম্বা ছিলেন বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম বিদেশী সুপারস্টার। ১৯৯০ সাল থেকে ৯৮ পর্যন্ত খেলেছিলেন এদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে, হয়ে উঠেছিলেন ঘরের ছেলে। এদেশের ক্রিকেটে জাগরণের এক নতুন হাওয়া বইয়ে দিতে পেরেছিলেন এই রমন লাম্বাই, যাকে দেখে শিখতে চাইতেন তার সাথে খেলা এখানকার সব ক্রিকেটার। অর্জুনা রানাতুঙ্গা যেমন গর্ব করে বলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে ঢাকায় এসে ক্লাব ক্রিকেট খেলেছিলেন বলেই বাংলাদেশের ক্রিকেটটা এগিয়েছে। এমন দাবি করার প্রথম অধিকার কিন্তু রমন লাম্বার।

রমন লাম্বারা এখানে এসে খেলার কারণেই এদেশের ক্রিকেট এক অসীম জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তাদের সাথে খেলা একটা প্রজন্ম পরবর্তীতে এদেশের ক্রিকেটে জাগরণের এক বিপ্লব ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি। উপর থেকে এদেশের ক্রিকেটের এ জাগরণ দেখে লম্বা উচ্ছ্বাসে ভাসেন, গর্ববোধ করেন। সাথে সাথে হয়তো কখনো কখনো মন ভারও হয়। যে ক্লাবের হয়ে খেলতে এসে জীবনটাই দিয়ে গেলেন সেই ক্লাব কিংবা এদেশের ক্রিকেট বোর্ড কেউই যে মনে রাখেনি লাম্বাকে।

দেশি সুপারস্টার মোনেম মুন্নাদের মনে না রাখা বিস্মৃতিপরায়ণ আবাহনী কোথায় দায় অনুভব করবে একজন ভারতীয় ক্রিকেটারকে মনে রাখার! লাম্বার মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের একটা বোলিং প্রান্তের নামকরণ হওয়ার কথা ছিল রমন লম্বার নামে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে মিরপুরে ক্রিকেট স্থানান্তর হলে সময়ের চক্রবাণে সে দায় থেকেও মুক্তি পায় ক্রিকেট বোর্ড।

কর্তাব্যক্তিরা রমন লাম্বাকে ভুলে গেলেও ভুলতে পারেননি খেলোয়াড়দের কেউ কেউ। এই যেমন মেহরাব হোসেন, যার ব্যাট থেকে ছোড়া বলের আঘাতই লম্বাকে ঠেলে দিয়েছিল মৃত্যুর কোলে। হয়তোবা এখনো কখনো কখনো লাম্বাকে মনে করে নির্ঘুম রাত কাটে মেহরাবের। প্রিয় লাম্বাকে মনে করে এখনো মনের কোণে বিষাদ ভর করে ঐ ম্যাচে আবাহনীর অধিনায়ক খালেদ মাসুদের।

কোথাও লাম্বা নেই, কিন্তু লাম্বার স্মৃতি ধারণ করে আছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাস আর আবাহনী মাঠের এক টুকরো জমি যেখান থেকে কফিন বন্দি লম্বা ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লিতে।

আজ দোসরা জানুয়ারি, ঢাকার ক্রিকেটে প্রথম সুপারস্টার রমন লাম্বার জন্মদিন। জন্মদিনে প্রয়াত এ ক্রিকেটারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link