আমি এসে গেছি

তারপর দেখলাম তাঁর ছোট্ট কিন্তু দীপ্ত একটা ইনিংস। দেখলাম অরুণলালের মাঝপিচে এসে বারবার দেওয়া সাবধান বাণী উপেক্ষা করে চারটে চারে সাজানো পাল্টা মার দেওয়া সেই তরুণের ঝকঝকে ২২, দিনের শেষে (বাংলার ৫৪/২ - এ দিনের শেষে অরুণলাল অপরাজিত ছিলেন ১০ রানে)। যেটা ঘোষণা করে ‘আমি এসে গেছি’(তার পরদিন ওই ২২-এই আউট হয়ে যান তিনি)।

তিন দশকেরও বেশি সময় আগের ধূসর না হওয়া একটা আলোকোজ্জ্বল স্মৃতি নিয়ে গল্প হোক আজ।

আগের দিন (২৩ মার্চ ১৯৯০) ইডেনে শুরু হয়েছিল ১৯৮৯-৯০ মৌসুমের রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল, বাংলা বনাম দিল্লী। টসে জিতে ব্যাট করে প্রথম দিনের শেষে দিল্লী করেছিল ১৬৮/৫, এক সময়ে যাদের রান ছিল ৯০/৫। লড়ছিলেন ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জেতা দলের সদস্য কীর্তি আজাদ, অপরাজিত ৫৮-তে দাঁড়িয়ে।

এই লেখাটা ঐ ম্যাচের দ্বিতীয় দিনটা নিয়ে। সে ছিল এক মেঘলা, অন্ধকার শনিবার, ২৪ মার্চ ১৯৯০। বেলা দেড়টা নাগাদ এজরা স্ট্রিটের একটা ব্যাঙ্কের শাখা (তখন শনিবার ছিল হাফ ডে) কেটে বছর বত্রিশের এক তখনো অপরিণত বাঙালি ক্রিকেটপ্রেমী (১৯৭২-এ ১৪ বছর বয়সে যে প্রথম রণজি ম্যাচ দেখেছিল এর ১৮ বছর আগে) দৌড় দিল ইডেনে। ১৯৮৯-৯০র বাংলা বনাম দিল্লীর রঞ্জি ফাইনাল দেখতে। বাংলার ঘোষিত নেতা সম্বরণ ব্যানার্জী। আর ‘নাথিং অফিসিয়াল অ্যাবাউট ইট’নেতা ছিলেন অরুণলাল।

তার পৌঁছনোর পরে পরেই দিল্লীর প্রথম ইনিংস শেষ হয় ২৭৮-এ, ১০০.৪ ওভার খেলে। কোশেন্ট ২.৭৬।বাংলা ইনিংস শুরু হল। খুব ধীরে, কোশেন্টে চোখ রেখে। আজও মনে আছে, ইন্দুভূষণ রায় ফেরেন নিজের ৭ রানে। নামেন অরুণলাল। আর একটু বাদেই নিজের ১১ রানে আউট হয়ে যান প্রণব রায় (যাকে ইএসপিএনক্রিকইনফো আজও দেখায় তার বাবা পঙ্কজ রায়ের নামে)।

দুই উইকেটে ২০ হয়ে যাওয়া বাংলা তখন বেকায়দায়। জাঁকিয়ে বসছেন দিল্লী পেসার জুটি মনোজ প্রভাকর-অতুল ওয়াসন, দু’জনেরই পকেটে একটি করে উইকেট তখন এবং হাতে আগুন ছোটানো লাল বল। এই সময় প্যাভিলিয়ন থেকে বেরিয়ে আসেন ছোট্টখাট্ট এক তখনও ১৮ না ছোঁয়া তরুণ, যার রঞ্জি অভিষেক ম্যাচ ছিল সেটা। যিনি টিমে এসেছিলেন তার আহত দাদার শূন্যস্থান পূরণ করতে।

তারপর দেখলাম তাঁর ছোট্ট কিন্তু দীপ্ত একটা ইনিংস। দেখলাম অরুণলালের মাঝপিচে এসে বারবার দেওয়া সাবধানবাণী উপেক্ষা করে চারটে চারে সাজানো পাল্টা মার দেওয়া সেই তরুণের ঝকঝকে ২২, দিনের শেষে (বাংলার ৫৪/২ – এ দিনের শেষে অরুণলাল অপরাজিত ছিলেন ১০ রানে)। যেটা ঘোষণা করে ‘আমি এসে গেছি’(তার পরদিন ওই ২২-এই আউট হয়ে যান তিনি)।

ওই পড়ন্ত বিকেলের বুক চিতিয়ে মার এবং তার দ্বারা প্রভাবিত নাছোড় অরুণলাল-রাজা বেঙ্কট জুড়িই তখন ভারতীয় ক্রিকেটে কুঁকড়ে থাকা বাংলাকে ৫১ বছর পরে আবার রঞ্জি এনে দেয় কোশেন্টের হিসেবে, ঐ বারবার বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচের শেষে (বাংলা ৬৩.৪ ওভারে ২১৬/৪, কোশেন্ট ৩.৩৯)।

ঐ ম্যাচে ‘আমি এসে গেছি’ জানিয়ে দেওয়া ঐ প্রায় ১৮ তরুণ সেদিন এসে গেছিলেন আমারও মনের দরজা খুলে। থেকে যেতে। তার অনেক পরে ১১ জানুয়ারী ১৯৯২তে হবে এক ম্যাচের জন্য ভারতের হয়ে একদিন-অভিষেক, তার চার বছর পরে ২০ জুন ১৯৯৬ সালে হবে টেস্ট অভিষেক। প্রথম দুই টেস্টে করবেন শতরান।

২০০০ সালে হবেন অধিনায়ক, গড়াপেটা কলঙ্কর অপমান থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবেন ভারতকে রাহুল-শচীন-কুম্বলেদের নিয়ে, বুক চিতিয়ে দেশে-বিদেশে জেতাটাকেই নিয়ম করে দেবেন, বাদ পড়বেন চ্যাপেল জমানায় ২০০৫ সালে, ফিরে আসবেন আগুনে পুড়েও ফিনিক্স হয়ে ২০০৬য়ে চ্যাপেলকেই উড়িয়ে দিয়ে, তারপর অবসরেও যাবেন ২০০৮ সালের নভেম্বরে। এগুলো ছিল, আছে, থাকবে।

কিন্তু আজও আমার কাছে তিনি মানে ঐ ২৪ মার্চ ১৯৯০-র পড়ন্ত, মেঘলা, প্রায়ান্ধকার, পরাকাষ্ঠার পরীক্ষা নেওয়া ইডেন-বিকেলে মনোজ-অতুলকে পাল্টা মার দেওয়া চারটে চারে সাজানো ঝকঝকে সেই ২২, যেটা আজও আমাকে জানিয়ে যায়, সাহস আর সদিচ্ছা থাকলে সব হয়, এমনকি এই কয়লা কালো দিনকালেও।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...