২০১১ সাল, হোসে মরিনহো নিজের বাড়িতে ছুটড়ি কাটাচ্ছেন। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই; হন্তদন্ত হয়ে তার বাড়িতে প্রবেশ করলেন জিনেদিন জিদান। ছুটির দিনে জিদানের আগমণ, বেশ জম্পেশ আড্ডাও হয়ে যাবে একটা, হোসে মরিনহোর ভাবনা ভাবনা হয়েই রইল। জিদানের হাতে একটা প্যাড। তা দেখেই বুঝলেন, এই ভাবনায় গুড়েবালি।
জিদানের হাতে থাকা ডিভাইসে ছিল ১৯ বছর বয়সী এক খেলোয়াড়ের খেলা। ডিফেন্ডার, এই মৌসুমেই ফরাসি লিগ ওয়ানে চমক দেখিয়েছে। পুরো ভিডিও দেখানো শেষে জিদানের প্রথম কথাই ছিল, তবে আমি এর সাথে কথাবার্তা শুরু করলাম? এখন শুরু না করলে যে কোনো দিন স্যার অ্যালেক্স হাইজ্যাক করবেন একে।
তরুণ সে তারকার খেলা দেখে মোরিনহোও না করেননি। পত্রপাঠে লেঞ্চ থেকে ফরাসি এক ডিফেন্ডার ভেরালো রিয়াল মাদ্রিদ। জিনেদিন জিদানের ফোন কলের কাছে সেদিন হার মানতে হয়েছিল স্যার অ্যালেক্সের ম্যান ম্যানেজমেন্টের।
১০ বছর পর সেরকমই এক দিনে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিলেন রাফায়েল ভারানে। গন্তব্য? ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। যে দলেই তার প্রথম যাওয়ার কথা ছিল। এত বছর পর রিয়াল মাদ্রিদ থেকে সর্বজয়ী হয়ে অবশেষে ইউনাইটেডে পারি জমিয়েছেন এই ফ্রেঞ্চ। ১০ বছর আগে স্কাউট করা খেলোয়াড়কে অবশেষে দলে পেয়ে কতটা লাভ করতে পারলো ইউনাইটেড? কতটাই বা লাভ হলো ভারানের?
রাফায়েল ভারানের রিয়ালে আগমণ ছিল একজন ইয়াংস্টার হিসেবে। মোরিনহো তাকে এল ক্লাসিকোতে নামিয়েছিলেন এক্সপেরিমেন্টের অংশ হিসেবে। আর তাতেই রাতারাতি স্টার বনে গিয়েছেন ভারানে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে আটকে ফিয়েছিলেন মেসিকে, গোল করে রিয়ালকে এনে দিয়েছিলেন লিডও!
সেখান থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেপে থাকাকালীন সময়েই হয়ে উঠেছিলেন রিয়াল ডিফেন্সের মূল ভরসা। তার চলে যাওয়ার পর হয়ে উঠেছিলেন রিয়ালের মূল একাদশের সদস্য। তাকে নিয়েই টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগসহ চার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে রিয়াল। সাদা জার্সিতে এমন কোনো শিরোপা নেই যা তার ছোঁয়া হয়নি। জিনেদিন জিদানের অধীনে নিজেকে আর ও ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
ফ্রান্সের হয়েও তার ক্যারিয়ারের গ্রাফটা উপরের দিকেই উঠেছে। ইউরো রানার-আপ, বিশ্বকাপজয়ী দলের মূল তারকা ছিলেন তিনি। প্রয়োজনে দলের আর্মব্যান্ডও উঠেছে তার হাতে। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন সর্বজয়ী এক খেলোয়াড়।
একজন খেলোয়াড় সর্বজয়ী হয়ে উঠলেই শুরু হয় বিভিন্নরকম দ্বিধা। সবার লক্ষ্য সমান থাকে না। একজন খেলোয়াড়ের জীবনে শেষ লক্ষ্যই থাকে জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা, ক্লাব লেভেলে নিজেকে প্রমাণ করা। কম বয়সে সবটা হাতে চলে আসার পর হারিয়ে যাওয়ার নির্দশনও আছে বৈকি।
ভারানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বিশ্বকাপ জেতার পর। পড়তি ফর্ম, খেলায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, জিনেদিন জিদান ফেরত এসে আবারও ঠিক পথে নিয়ে এসেছিলেন তাকে। আর জিদানের চলে যাওয়ার পরই ক্যারিয়ারের নতুন লক্ষ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন ভারানে। আর সেই লক্ষ্য হলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রতিশব্দ হয়ে উঠা স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘অ্যাটাক জেতায় ম্যাচ, ডিফেন্স জেতায় ট্রফি’। সেই ফার্গুসন চলে যাওয়ার পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হাতে গুনে শিরোপা পেয়েছে মাত্র ৪টি। শুধু কী তাই, একসময় ইউনাইটেডের ডিফেন্স সামলাতেন যেখানে ফার্ডিন্যান্ড-ভিডিচ, সেখানে একসময় দেখতে হয়েছে ফিল জোনস-মার্কাস রোহোকে।
ইউনাইটেড ডিফেন্সের বেহাল দশা কোনোমতে সামাল দিয়েছিলেন মোরিনহো, তাতে করেই চার শিরোপার দেখা পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লম্বা সময়ের জন্য তা য্যথেষ্ট ছিল না। তাই নিয়ে আসা হয়েছিল স্যার অ্যালেক্সের যোগ্য শিষ্য ওলে গুনার শ্যুলশারকে।
শ্যুলশার কোনো ট্রফিজয়ী ম্যানেজার হয়ে আসেননি, বরং এসেছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ঠিক করতে। ডেভিড ময়েস, ভ্যান হাল, মোরিনহোর পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে আবারও পথে আনার প্রচেষ্টা তার। সে লক্ষ্যে অটুট তিনি এখনও পর্যন্ত। গুটি গুটি পায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ইউরোপা লিগ ফাইনালেও। কিন্তু ঐ যে ডিফেন্সটা এখনও পাকাপোক্ত করতে পারেননি, খেসারতটা দিতে হয়েছে ফাইনাল হেরে।
আস্তে আস্তে দলকে ভালো একটা অবস্থানে নিয়ে এসেছেন শ্যুলশার, দলের মূল ডিফেন্ডার হিসেবে আছেন ইংলিশ ডিফেন্ডার হ্যারি ম্যাগুইয়ার। ডিফেন্সের তিনটি পজিশনই আয়ত্বে নিয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু ম্যাগুইয়ারের যোগ্য সারথি এখনও খুঁজে পাননি। আর সে জায়গা পূরণ করার জন্যই নিয়ে এসেছেন রাফায়েল ভারানেকে।
রাফায়েল ভারানে হচ্ছেন হ্যারি ম্যাগুইয়ারের পারফেক্ট কাউন্টার-পার্ট, ম্যাগুইয়ার যেখানে ডিফেন্সের লিডার, চিৎকার-চেচামেচি করে দলকে উদ্বুদ্ধ করেন, ভারানে সেখানে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ চালিয়ে যান। যেটা এতদিন ধরে রিয়ালে করছিলেন সার্জিও রামোসের সঙ্গে, সেটাই এখন করবেন ম্যাগুইয়ারের সাথে।
রামোস চলে যাওয়ায় রিয়াল ডিফেন্সে তার হয়ে উঠার কথা ছিল লিডার, যেটা কখনোই ঠিক ভারানের মধ্যে ছিল না। ফলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তার আসাটা নিজের জন্যই ভালো হয়েছে।
শুধু তাই নয়, ভারানের রিয়ালের হয়ে সব জিতে যাওয়াও বড় একটা প্রভাব ফেলেছে এখানে। ১১ বছর কাটিয়ে ফিয়েছেন রিয়ালে, সব জিতেছেন, কিন্তু এরপরেও বর্তমান সময়ের সেরা ডিফেন্ডার লিস্টে তার নামটা বড় করে কেউ বলে না।
নিজের খেলা অনুযায়ী ঠিকঠাক হাইপটা পাননি তিনি মিডিয়া থেকে। সেটা হতে পারে রামোসের অধীনে থাকার জন্যই। আর মিডিয়ার সুনজরে আসার জন্য ইংলিশ লিগের থেকে বড় জায়গা আর কী-ই বা হতে পারে।
প্রিমিয়ার লিগে গত কয়েক মৌসুম ধরে ডিফেন্ডাররাই বদলে দিচ্ছে দলের চেহারা। এই যেমন লিভারপুল, ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীনে ভার্জিল ভ্যান ডাইকের আগমণ বদলে দিয়েছে লিভারপুলের চেহারা। একে তো দলে গোল হজম কমেছে, ডিফেন্সেও তারা পেয়েছে একজন লিডার। গত মৌসুমে তার ইনজুরি পুরোপুরি ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছিল লিভারপুলকে।
গার্দিওলার ক্ষেত্রে রুবেন ডিয়াজ। মাঝপথে এসে পর্তুগিজ এই ডিফেন্ডার খোলনচালে বদলে দিয়েছেন গার্দিওলার মৌসুম। অর্ধেক মৌসুম পর্যন্ত খাবি খাওয়া সিটি, পৌছেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে। লিগও জিতে নিয়েছে বড় ব্যবধানে। গত মৌসুমে চেলসির ট্রাম্পকার্ডও ছিলেন ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভা। এখন দেখার বিষয় ভারানে ইউনাইটেডের ট্রাম্পকার্ড হয়ে উঠতে পারেন কীনা?
ইউনাইটেড, রিয়াল, ভারানে তিনপক্ষের জন্যই লাভবান একটা ট্রান্সফার হয়েছে এটি। ইউনাইটেডের দরকার ছিল একজন সলিড ডিফেন্ডার, এই মার্কেটে ভারানের মতন প্রুভেন ডিফেন্ডার নেই বললেই চলে। রিয়ালের প্রয়োজন ছিল টাকা। এক বছর বাকি ছিল ভারানের কন্ট্রাক্টের, তাকে এখন বিক্রি না করলে পরের মৌসুমে হয়তো ফ্রিতেই ছাড়তে হতো রামোসের মতন।
সেই সাথে রিয়ালের ড্রিম প্রজেক্ট এমবাপ্পেকে আনতেও অর্থের প্রয়োজন, ভারানেকে দিয়ে সেটাও হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে ভারানে চাচ্ছিলেন নতুন চ্যালেঞ্জ, বেশি বেতন আর হাইপ; তিনটাই পাচ্ছেন ইউনাইটেডে গিয়ে।
তিনপক্ষের জন্যই লাভবান এক ডিল শেষে এখন অপেক্ষা সিজন শুরুর। ইতিহাস বলে রিয়াল ছেড়ে যাওয়া কোনো খেলোয়াড়ই পরে গিয়ে নিজের নামের সুনাম করতে পারেননি। ভারানে কি পারবেন নিজেকেও ছাড়িয়ে যেতে, নাকি হবেন ইংলিশ মিডিয়ার আরেক বলি?