আ্যডিলেডের রূপকথা গড়ার তিনি সবচেয়ে বড় কারিগর। ব্যাট হাতে হার না মানা এক শতক। বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ব আসরে প্রথম। সেই আসরে শতকের দেখা পেলেন পরপর দুটো।
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবেই বিশ্বকাপে পরপর দু শতক। হোক হোম সিরিজ কিংবা বিশ্ব আসর। সকল পরিসংখ্যানেই প্রথমবার তিনি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ২০১৭ এর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি কোথাও থেমে থাকেনি তার শিকারী চোখ।
দলে থিতু হতে নিয়েছেন দীর্ঘ সময়।
ধীরগতির ব্যাটিং নিয়ে সমালোচিত হয়েছেন বহুবার। পরিপক্ব হতে সময় প্রয়োজন, এই কথার প্রমাণ মিললো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মাধ্যমেই। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে রিয়াদের শুরুর দিকটার সাথে বর্তমান উদ্যমী রিয়াদের অনেকাংশে পার্থক্য পাওয়া যায়। ওয়ানডেতেও তিনি ৪০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করেছেন শুরুর অনেক ম্যাচে। সমর্থকদের মাঝে ছিলো তাকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও ক্ষোভ। এতকিছুর মাঝেও শুরু থেকেই তাকে ফিনিশার হিসেবে পাওয়া যাচ্ছিলো। বিপদের মুখ থেকে দলকে টেনে তুলতে তিনি সর্বদাই ছিলেন ওস্তাদ।
উপরে তিনি সবসময় ব্যাটিং করতে চান। মন গলাতে পারেন না নির্বাচকদের। যে বার পেরেছিলেন, সেবার দলের ওপেনিংয়ে চলছিলো দূর্দশা। বিশ্বকাপে নিয়মিতভাবেই ব্যর্থ ওপেনিং যুগল। অঘোষিতভাবেই মাঠে ওপেনিংয়ের ভূমিকায় রিয়াদ-সৌম্য। তাদের শটেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতো টিম বাংলাদেশ। নবাগত সৌম্য দ্রুত ইনিংসে রঙ ছড়ালেও, রিয়াদ কাঁধে তুলে নিতেন দায়িত্ব। বৈরি পরিবেশে লড়াই চালিয়ে যেতেন।
বিশ্বকাপে নিজেদের কোনো সেঞ্চুরিয়ান নেই! আক্ষেপেরও তাই শেষ নেই। ২০১৪ সাল পুরো দলের জন্য ভালো যায়নি। নতুন অধিনায়কের হাত ধরে বৈরি পরিবেশের বিশ্বকাপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু বাংলাদেশ দলের, একমাস পূর্বে। এই সময়টুকু কাজে দিয়েছে। নিজেরা নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েছেন। বিশ্বকাপের পূর্বেই নিজেকে শারীরিকভাবে ঝালিয়েছেন রিয়াদ। ফল ধরা দিলো অ্যডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ইংলিশ পেসারদের দানবীয় পেস ও সুইংয়ে দিশেহারা দুই ওপেনারের ব্যর্থতায় চার নম্বরে ব্যাটিংয়ে এসে বুক চিতিয়ে লড়েছেন।
ব্রড- অ্যান্ডারসন জুটির সুইং আর জর্ডানের বাউন্সার কোনোটিই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। মাঠের চারপাশে চার-ছয়ের পসরা সাজিয়েছেন। সকাল সকাল বিছানা ছেড়ে উঠা ২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা সুসময় কাটিয়েছে রিয়াদের ইনিংসে। পরীক্ষার ক্লান্তি ভুলেছে, মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে। বাংলাদেশের ঘড়ির কাঁটায় যখন দুপুরের আগমন, এমন সময়েই রিয়াদ গড়লেন ইতিহাস। হলেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ব আসরের সেঞ্চুরিয়ান।
উল্লাসটা শুধু রিয়াদের নয়! অপরপ্রান্তে থাকা মুশফিকেরও। ক্যামেরার লেন্স মুশফিকের উল্লাসটাও খুঁজে নিলো। ডাগআউটে বাকিদের উচ্ছ্বাস বাঁধভাঙা।
এই ইনিংস খেলতে রিয়াদকে ব্যাপক কষ্ট করতে হয়েছে। দানবীয় পেসারদের ভয়ংকর রূপ তাকে অস্বস্তিতে রেখেছে। মনযোগের ঘাটতি হলেই বিপদের শঙ্কা! সবকিছু জেনেই ছিলেন মাঠে পূর্ণ মনযোগী। এমন ক্ষিপ্রতায়-ই তো ইতিহাস তৈরি হয়। পরের ম্যাচে কিউইদের বিপক্ষেও সমান ক্ষুরধার রিয়াদের উইলো। ওপেনাররা পুনরায় ব্যর্থ। আসরের আরেক স্বাগতিকদের বিপক্ষে তাদের মাঠেই জয়ের আশা করা দূরূহ ব্যাপার হলেও আশা দেখিয়েছেন রিয়াদ। পুনরায় শতকের দেখা মিললো তার ব্যাটে। শাসন করে গেছেন অনায়াসেই কিউই বোলারদের।
কিউইদের বিপক্ষে ইনিংসে রিয়াদ পুরো দলের সংগ্রহের দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি, আদর্শ সমাপ্তির ভূমিকায় রেখেছেন। ফিনিশার হিসেবে রিয়াদ কে এই কারণেই তো প্রাধান্য দেওয়া হয়। বর্তমান দলে রিয়াদের ভূমিকাই তো এটি। রিয়াদ স্বাচ্ছন্দ্যে পালন করে যান প্রতিম্যাচে। কিউইদের বিপক্ষে সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জয় না পেলেও, পর্দার আড়ালের একজনের বিধ্বংসী রূপ পুনরায় প্রকাশ পেয়েছিলো। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাপ্তিতে নতুন একজন যোগ হয়েছে। রিয়াদ বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাপ্তিতে নতুন ছিলেন না! তবে স্বীকৃতি ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকেই এসেছিলো।
বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে বেশীরভাগ ম্যাচেই তাকে লোয়ার-অর্ডারে ব্যাটিং করতে হয়েছে। ত্রাণকর্তার ভূমিকায় তাকে ফিনিশার হতে হয়েছে। দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ দারুণভাবেই। সবদিন সফল সবাই হয়না! প্রমাণ হিসেবে রিয়াদের ব্যাপারে উদাহরণ চেন্নাইয়ের চিন্বাসোয়ামী স্টেডিয়াম। এই পাপমোচন হয়েছে ২০১৯ সালে দিল্লীতে। সে যাই হোক, রিয়াদের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। রিয়াদ মূলত আইসিসি টূর্ণামেন্টের নায়ক। বড় আসরের নায়ক। ২০১৫ এর বছর দুয়েক পর ২০১৭ এর চ্যাম্পিয়ন’স ট্রফিতে পুনরায় জ্বলে উঠলেন রিয়াদ।
কিউইদের সুইংয়ে দিশেহারা টিম বাংলাদেশ। চল্লিশ না পেরোতেই দলের চার ব্যাটসম্যান সাজঘরে। মাঠে সঙ্গী হিসেবে রিয়াদের পছন্দ সাকিব। এবার পেয়েও বসলেন। ব্যাটিং করার মত পেলেন অসংখ্য ওভার। যে যার মত ব্যাটিং করলেন! ম্যাচের আবহাওয়া পাল্টাতে লাগলো। কিউইদের কপালে চিন্তার ভাঁজ চওড়া হচ্ছিলো। রিয়াদ-সাকিবের দৃঢ়তায় সকল পরিকল্পনাই তাদের ব্যর্থ হচ্ছিলো।
রিয়াদের দৃঢ় ব্যাটিংয়ে ইয়ান বিশপ বলতে বাধ্য হলেন, ‘ছোটো-বড় সকল মাঠেই এই শট ছয়।’ নাসের হুসেনের কাছে, ‘রিয়াদ সবসময় আইসিসি ইভেন্টের খেলোয়াড়।’
নাসের হুসেইনের তাঁকে নিয়ে এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক। আইসিসি ইভেন্টে পরপর দুই আসরে তার তিন শতক! শুধু নাসের হুসেইন কে নয়, বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে বাকি ক্রিকেট বিশ্লেষকদেরও। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে করতে রিয়াদ এখন বড় ধরণেই খুনী। ম্যাচে তার এই ভূমিকা প্রশংসিত বারংবার। দলে ফিনিশিং রোল প্লে করা একজনের চাহিদা দীর্ঘদিন ধরেই মিটিয়ে আসছেন তিনি। সময়ের পালাক্রমে বয়স আজ ৩৫।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার তার শেষ হয়ে আসছে। তবে তার ভূমিকা অপরিসীম দলে। তাই বাংলাদেশ দলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আরোকিছু মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ প্রয়োজন।