চার বছরে সব ওলট-পালট!

উন্মাদনা ছাড়িয়ে গেছে উপমহাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সূদর পশ্চিমে। শুরু হয়েছে ক্রিকেটের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের সবচেয়ে বড় আসর – টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ উপহার দিয়ে গত চৌদ্দ বছরে ক্রিকেট পাগল মানুষের মনে আলাদা এক জায়গা করে নিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। যদিও এখনো ওয়ানডে বিশ্বকাপকেই সবচেয়ে সম্মানীয় বৈশ্বিক ইভেন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়।

কিন্তু তাই বলে যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পিছিয়ে থাকবে তা কিন্তু নয়। ইতোমধ্যেই এর চাহিদা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে আপামর জনতার মাঝে। অপেক্ষায় থাকেন এখন সকলেই। ২০২০ সালে হবার কথা থাকলেও করোনা মহামারীর ভয়াল থাবায় তা পণ্ড হয়ে যায়। বছর খানেক অপেক্ষার অবসান। মারাকাটারি ব্যাটিং এবং বোলারদের আগুন ঝড়ানো বল দেখার সাধ এবার তবে মিটবে।

আজ একটু স্মৃতি রোমন্থনের ইচ্ছে নিয়ে হাজির। ২০১৬ সালে শেষ যেবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হলো সেই বিশ্বকাপে ঘটে যাওয়া কয়েকটা ঘটনার পসরা সাজিয়েছি এবার। আবছা হয়ে যাওয়া স্মৃতির গহীন গহ্বর থেকে ঘুরে আসা যাক।

  • যুবরাজের পরিবর্তে মানিশ পান্ডের অন্তর্ভুক্তি। 

২০১৬ তে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে, এবারও তেমনটা হবার কথা থাকলেও হচ্ছে না। তবে বেশ রোমাঞ্চকর সেই বিশ্বকাপটা ভারতীয়দের ছিল আরো বেশি আবেগ জাগানিয়া এরই সাথে আশায় বুক বেঁধেছিলেন ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জয়ের। তাছাড়া এটা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল ভারতে অন্যতম সেরা কিংবদন্দি, তারকা অলরাউন্ডার যুবরাজ সিং নিতে পারেন অবসর।

তাই যুবরাজের বিদায় বেলায় তাঁর হাতে এই ক্ষুদ্র সংস্করণের ট্রফিটি দেখতে চেয়েছিলেন ভারতের প্রায় একশো কোটি সমর্থকেরা। কিন্তু নিয়তির কি অদ্ভুত রকমের অবিচার। অস্ট্রেলিয়ার মতো পরাশক্তিকে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে ওঠা ভারতের ঘরে আসে এক দু:সংবাদ।

গোড়ালির ইনজুরিতে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যান যুবরাজ সিং। ভাগ্য বিধাতা যেন পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেন। স্বপ্নের পরলোকগমনের সম্ভাবনার দূর ঈষাণ কোণে উদিত হতে শুরু করে। সুযোগ পান মানিশ পান্ডে। তবে, মানিশ কখনোই জাতীয় দলে জায়গা পাঁকা করতে পারেননি। সেই মানিশ পান্ডে অবশ্য ২০২১ সালের বিশ্বকাপে আর জায়গা পাননি।

  • মোহাম্মদ নবী ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেট শিকার 

২০১৬ এর বিশ্বকাপের ডাকহর্স ধরা হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানকে। নবাগত দল হিসেবে ক্রিকেট দুনিয়ার বড় বড় দলগুলোকে বেশ ভুগিয়েছে আফগান খেলোয়াড়েরা। প্রতিভাবান যুবা খেলোয়াড়েরা বাংরবার অবাক করেছে ক্রিকেট বিশ্বকে। তবে তাঁদের মধ্য়ে একজন ছিলেন ধারাবাহিক। তিনি মোহাম্মদ নবী। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং পরিপক্ক খেলোয়াড় মোহাম্মদ নবী পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ছিলেন আফগানিস্তানের আস্থাভাজন।

তিনি ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ১২টি উইকেট শিকার করে ছিলেন উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকার শীর্ষে। নবী অতি-অসাধারণ স্পিন বোলার ছিলেন না। তিনি তাঁর লাইন লেন্থ ঠিকঠাক রেখে ফিল্ডিং পজিশন অনুসারে ধারাবাহিকভাবে বল করে যেতেন। সাধারণত প্রথম পাওয়ার প্লে শেষ হবার পরে নবী বল করতে আসতেন। ব্যাটাররা সাধারণত সেই সময় মনোযোগ দিতেন ফাঁকা জায়গায় বল পাঠিয়ে এক-দুই করে রান বের করে নেবার।

নবী তাঁদের সেই মনোভাব বুঝে সিঙ্গেল বের করার সুযোগ কমিয়ে ব্যাটারদেরকে চাপে ফেলে দিতে। এভাবেই বুদ্ধিমত্তার সাথে তিনি বনে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। যদিও, এর সুবাদে মোহাম্মদ নবী ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান, আর চলতি বিশ্বকাপেও তিনি এসেছেন আফগানিস্তানের অধিনায়ক হয়ে।

  • সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম ইকবাল

বাংলাদেশের ড্যাশিং ওপেনার তামিম ইকবাল বরাবরের মতোই ছিলেন দলের ব্যাটিং অর্ডারের ভরসা স্তম্ভ। তাঁর ব্যাট হেসে উঠলেই যেন প্রতিপক্ষের বিপক্ষের জয়ের আশায় বুক বাঁধতো পুরো দল। সেই তামিম তাঁর ভরসার প্রতিদান দিয়েছিলেন ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। রীতিমত সবাইকে অবাক করে দিয়েই বনে গিয়েছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

তামিম ইকবাল ২০১৬ বিশ্বকাপের ছয় ম্যাচে প্রায় ৭৪ গড়ে রান করেছিলেন ২৯৫। তাঁর স্ট্রাইকরেট ছিল প্রায় ১৪২। ১৪ টি ছক্কা এবং ২৪ টি চারের সমন্বয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে যান সেরাদের শীর্ষে। ওমানের বিপক্ষে বিধ্বংসী একটি শতকও হাকান বাংলাদেশের সেরা ওপেনার তামিম ইকবাল। স্বভাবতই তিনি একটু মারকুটে ব্যাটার।

তবুও ক্রিস গেইল, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ভিরাট কোহলির মতো ব্যাটারদেরকে পেছনে ফেলে তাঁর এই কৃতীত্বে সকলে খানিক অবাক হয়েছিলেন বটেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি তামিম ইকবালের টুর্নামেন্ট সেরা পারফর্মেন্সের পরেও বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয়। তবুও স্মৃতির পাতায় চির অমলিন হয়ে রইবে তামিম ইকবালের এই অসাধারণ পারফরম্যান্স।

  • ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরেছিল নবাগত আফগানিস্তানের বিপক্ষে

যেমনটা আগে বলেছিলাম আফগানিস্তান তাঁদের অনবদ্য পারফর্মেন্সের বদৌলতে ডার্ক হর্স উপাধি পায়। তাঁরা ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এমন এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়েছিল যা ছিল সকলের চিন্তার বাইরে। তাঁরা গ্রুপ পর্বের ম্যাচে সেবারের চ্যাম্পিয়ন দল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়েছল, পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে। অভিজ্ঞতা, পেশী শক্তির বিচারে এগিয়ে থেকেও উইন্ডিজরা হেরেছিল আফগানদের কাছে।

সেবার গ্রুপ পর্বের ম্যাচটিতে প্রথমে ব্যাটিং করে আফগানিস্তান মাত্র ১২৭ রানের মামুলি পুঁজি সংগ্রহ করতে সক্ষন হয় সাত উইকেটের বিনিময়ে। পক্ষান্তরে ছোট টার্গেটে খেলতে নামা উইন্ডিজরা রীতিমত খাবিখায়। রাশিদ, নবীদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং এ ১১৭ রানেই আটকে যায় ড্যারেন সামির নেতৃত্বাধিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গেইল, ব্রাভো, লুইসদের মতো বাঘাবাঘা ব্যাটাররা থাকতেও ছোট টার্গেটটা আকাশ সমান মনে হয়ে উইন্ডিজদের।

আফগানিস্তান দল এরপর নিজেদের মধ্যে আরো উন্নতি এনেছে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সাথে সাথে এখন তাঁরা টি-টোয়েন্টিতেও বড় শক্তি। এবারের বিশ্বকাপ তাঁরা খেলবে সরাসরি মূলপর্বে।

  • নকআউট স্তরে সর্বোচ্চ রান তারার রেকর্ড

২০১৬ এর বিশ্বকাপে রেকর্ডের ফুলঝুরি দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। কতশত নতুন রেকর্ডের জন্ম হয়েছিল সেই টি-২০ বিশ্বকাপে। উইন্ডজরা রেকর্ড গড়বে না তা কি আর হয়? তারাও রেকর্ড গড়লেন অনন্য রেকর্ড। টি-২০ বিশ্বকাপের নকআউটে পর্যায়ে জয় ছিনিয়ে নিয়ে এলেন রেকর্ড পরিমাণ রান তাড়া করে।

স্বভাবতই যেকোন টুর্নামেন্টের নকআউট পর্যায় টুর্নামেন্টের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এবং কঠিনতম পর্যায়। সেখানে যেন প্রতিপক্ষের সাথে সাথে লড়তে হয় স্নায়ুবিক এক যুদ্ধ। একটুখানি ভুল আর ছিটকে যাবার সম্ভাবনা পুরো টুর্নামেন্ট থেকে। তেমনই এক সমীকরণ নিয়ে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিরাট কোহলির অসাধারণ ৮৯ রানের অপরাজিত ইনিংস এবং রোহিত, রাহানের ব্যাটিং নৈপুণ্যে উন্ডিজদেরকে ১৯৩ রানের এক বিশাল পাহাড় সমান টার্গেট ছুড়ে দিতে সক্ষম হয় ভারত।

তবে ভারতীয় ফিল্ডারদের ভুলে বেশ ক’বার আউটের মুখ থেকে বেঁচে ফিরে উইন্ডিজ ব্যাটাররা। যেমনটা আগে বলেছিলাম নকআউট পর্যায়ের ভুল করবার সুযোগ অত্যন্ত নগন্য। ভারতের ভুলের বদৌলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান সিমন্স ৫১ বলে ৮২ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলেন।

আর শেষের দিকে আন্দ্রে রাসেলের ২০ বলে ৪৩ রানের এক দুর্দান্ত ক্যামিওর উপর ভর করে পাহাড় সমান বিশাল টার্গেট পেড়িয়ে ফাইনালে উঠে যায় ড্যারেন সামির দল। যারা কি না গ্রুপ পর্যায়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১২৭ রান করতে ব্যর্থ হয়, তারাই আবার সেমিফাইনালে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে রেকর্ড গড়ে জয় ছিনিয়ে নেয়।

  • সেবার অধিনায়ক, এবার মেন্টর

২০১৬ সালে শেষবারের মত কোনো আইসিসি ইভেন্টে অধিনায়ক হিসেবে খেলতে নামেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। ভারতের যাত্রা শেষ হয় সেমিফাইনালে গিয়ে। সেমিফাইনালে দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হেরে বিদায় নেয় ভারত।

এরপর আরো দু’টি আইসিসি ইভেন্ট খেলেন ধোনি। ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। তবে, দুবারের কোনোবারই তিনি অধিনায়ক ছিলেন না। এরপর ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের আর আর জাতীয় দলে ঠাঁই হয়নি তাঁর।

গত বছর তিনি জাতীয় দল থেকে অবসর নেন। তবে এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আবারো জাতীয় দলে ফেরানো হয়েছে তাঁকে। তবে, এবার মাঠে নয়, তাঁর দায়িত্ব মাঠের বাইরের। তিনি ভারতীয় দলের মেন্টর হয়ে এসেছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link