অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস স্মরণিকা

অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে কিভাবে মনে রাখবো? বা বলা ভালো রাখা উচিত। মাঙ্কি গেট? বেহিসেবি, অপিরিমিত জীবন যাপন? নাকি তাঁর অদ্ভুত চুল এবং ঠোঁটে মাখা জিঙ্ক ক্রিমের জন্যে? এই লেখককে জিজ্ঞেস করলে, উত্তর এর কোনোটিই নয়। সেই ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এর ইনিংসটির জন্যে সাইমন্ডস এই অধমের মনে আজীবন বিরাজ করবেন। ২০০৩ এর বিশ্বকাপ। জোহানেসবার্গে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ম্যাচ।

গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন এবং মধ্যবর্তী সময়ে সবচেয়ে পরাক্রমশালী দল হওয়া সত্ত্বেও ওয়াকারের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া শুরু করেছে দু’কদম পিছিয়ে। একে তো বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ওয়ার্ন নিয়ে বিতর্ক। অজি দলের অন্যতম দুই স্তম্ভ, ড্যারেন লেম্যান ও মাইকেল বেভানও দলের বাইরে। প্রথম জন নির্বাসিত, দ্বিতীয় জন চোটের কারণে।

এহেন পরিস্থিতিতে খানিক বাধ্য হয়েই বোধহয় কদিন আগেও ক্রিকেট ছেড়ে রাগবি খেলার কথা ভাবা সাইমন্ডসকে সেদিন সুযোগ দেওয়া হয়। তা ওয়াসিম, ওয়াকাররা শুরুতেই অস্ট্রেলিয়াকে চরম ধাক্কা দেন। ৮৬ রানে ৪ উইকেট, এই অবস্থায় সাইমন্ডস আসেন, দেখেন এবং জয় করেন। কি কি সব শট খেলছিলেন সেদিন।

শোয়েব আখতার, ওয়াকার ইউনুস, ওয়াসিম আকরামকে এমন ভাবে পিটছিলেন, যেন তাঁরা কুইন্সল্যান্ডের শিক্ষার্থী বোলার। ১২৫ বলে ১৪৩ রান করেন সেদিন সাইমন্ডস। নিরেট সংখ্যায় তো বটেই, ইম্প্যাক্টেও সেই ইনিংস অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। স্টিভ ওয়া পরবর্তী পন্টিংয়ের দল স্টিভ ওয়াহরই আক্রমণাত্মক, শক্তিশালী ও ঝুঁকিপূর্ণ বদলি পেলো।

সাইমন্ডস বরাবরই ছিলেন, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গাং-হো’ ব্যাট। সেই কোন ছোট বয়সে গ্লস্টারের হয়ে খেলতে গিয়ে গ্লামর্গ্যানের বিরুদ্ধে ২৫৪ রানের ইনিংসে ১৬টি ছয় মেরেছিলেন। গিলবার্ট জেসপের দল, গ্লস্টারশায়ারের হয়ে সাইমন্ডস একসময় খেলেছেন, ব্যাপারটা বোধহয় ক্রিকেট দেবতারই ঠিক করে দেওয়া।

নিশ্চয় তরুণ সাইমন্ডস বহু বল পাঠিয়েছেন জেসপের স্মৃতিবিজড়িত সেই জেসপ ট্যাভার্নে। কিন্তু জেসপের মতো সাইমন্ডসের ঝুঁকি নেবার প্রবণতা অবশ্য গ্লস্টার কোচের খুব একটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু এই ঝুঁকি নিতে পারার বুকের খাঁচাটা ছিলো বলেই না সাইমন্ডস বিপক্ষের বুকে কাঁপুনি ধরাতেন।

টেস্ট ক্রিকেটার সাইমন্ডস কখনোই পূর্ণতা পাননি। কিন্তু বার্মিংহ্যামে জন্মানো সাইমন্ডস, যিনি খুব সহজেই ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে পারতেন, তাঁর স্বপ্ন ছিল ব্যাগি গ্রিন মাথায় দেবার। ২০০৭-০৮ মরসুমের আগে দলে নিয়মিত হতে পারেননি।

কিন্তু, ২০০৭-০৮ মৌসুমকে স্বচ্ছন্দে সাইমন্ডসের মৌসুম বলা যায়। মাঠে ও মাঠের বাইরেও। মাঠে তিনি সেই মৌসুমে করেন ৯ টেস্টে ৭৭৭ রান (দেশ বিদেশ মিলিয়ে), ৭৭.৭০ গড়ে। সিডনিতে তাঁর টেস্ট কেরিয়ারের সর্বোচ্চ ১৬২ রান করার পরেই, ওই একই টেস্টে জড়িয়ে যান মানকি গেট কাণ্ডে।

ভারতে সেই সময়টা বোধহয় সাইমন্ডস অন্যতম ঘৃণ্য ক্রিকেটারের তকমা পেতেন। অথচ, কি আশ্চর্য্য, আই.পি.এল দলগুলো সাইমন্ডসের জন্যেই বিশাল অংকের টাকা নিয়ে চুলোচুলি করে । ২০০৮ মরসুমে মাত্র ৪ ম্যাচ খেলবেন জেনেও। ২০০৯ মৌসুমে তাঁর সুফল পায় ডেকান চার্জার্স। ডেকান চার্জার্সকে চ্যাম্পিয়ন করতে বিরাট ভূমিকা নেন সাইমন্ডস। ক্রিকইনফোর স্মার্ট স্ট্যাট বলছে, গিলক্রিস্ট, হেডেন, রায়না, কুম্বলেকে ছাপিয়ে সেই আইপিএলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় সাইমন্ডস।

এতো কিছুর পরেও, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস কে নিয়ে যখনই কথা হয়, সম্ভাবনা বনাম ফলাফলে একটা বড়োসড়ো ফারাক চোখে পড়েই যায়। এর কারণ সাইমন্ডসের উৎশৃঙ্খল জীবনযাপন। জানিনা ক্যারিবিয়ান,উপমহাদেশ এমনকি ইংল্যান্ডের হয়ে তিনি খেললে কি হতো। কারণ সেখানে ব্যক্তিগত জীবনে চরম বেহিসেবি ক্রিকেটাররা যদি প্রতিভাশালী হন, তাঁদের মাথায় করে রাখা হতো। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে তা হবার নয়।

শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে যেখানে পন্টিংকেও বাদ যেতে হয়। সাইমন্ডসকে বুঝতে হতো, কাউবয় হ্যাট ও হাওয়াই চটি পরে মিটিংয়ে আসা এক আধবার পার পেতে পারে। কিন্তু বারবার মাছ ধরতে গিয়ে মিটিংয়ে না আসতে পারা, বা পাবে নিয়মিত মারপিঠ করা চরম পেশাদার, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া মেনে নেবে না। কাজেই ২০০৮-০৯ নাগাদ সাইমন্ডসের জাতীয় দলের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। সাইমন্ডস মানেই বোধহয় অকালে শেষ হয়ে যাওয়া। তা সে ক্রিকেট জীবন হোক বা মনুষ্য জীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link