বাংলার ক্রিকেট সন্ন্যাসী

২৬ আগস্ট ২০১৮।

কালান্তক ২৬ আগস্ট ২০১৮’র সকালে মাঝে মাঝেই মেঘলা আকাশ ছিল, যদিও বৃষ্টি হয়নি তেমন। মাঝে মাঝে রোদও তো উঠছিল। কিন্তু সাড়ে এগারোটা নাগাদ পাওয়া খবরটায় মনের আকাশের পুরো দিনটাই তো মেঘলা হয়ে গিয়েছিল। খবরটা জানিয়েছিল, জীবনের ইনিংস থেকে গোপাল বসু আউট হয়ে গেছেন, ৭১ বছরের অসময়েই। অসময়ে শেষ করা নিজের খেলা জীবনের মতই। আরেকটু দরিদ্র হয়েছিল বাংলার ক্রিকেট সেদিন।

আর আমি? একটা একটা করে খসে পড়তে দেখছিলাম আমার কৈশোরের রূপকথা-প্রাসাদের খিলানগুলো। আমার কৈশোরের আর এক নায়ক বাংলার ক্রিকেট সন্ন্যাসী গোপাল বসুও কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন। সেদিন ভাবছিলাম, ভারাক্রান্ত এই মনে আরও কি কি দেখতে হবে জানি না।

২০ মে ২০২১।

আজ মনে পড়ছে, অসময়ে নিজের খেলা শেষ করতে বাধ্য হবার পরে তিনি এসেছিলেন কোচিংয়ে। মূলত জোর দিতেন ‘হাই ব্যাকলিফট’, মাথা সোজা রাখা আর স্ট্যান্সের উপর। তারপর ছিল মসৃণ কভার ড্রাইভের টিপস। আর তার থেকেও পরিষ্কার ছিল তার মস্তিক প্রসূত ক্রিকেট বিশ্লেষণ। নিজের খেলোয়াড়ী জীবনে প্রতি পদে পাওয়া শিক্ষাটাই তার কোচিং টিপসের মূলমন্ত্র ছিল – ‘শুধু ব্যাটিং বা বোলিং দিয়ে কখনোই টেকা যাবে না, অলরাউন্ডার হতে হবে।’

গোপাল বসুর মৃত্যু বলে কিছু হয়, আমি বিশ্বাস করি না। তিনি থেকে গেছেন তাঁর কীর্তির মধ্যে।

২১ সেপ্টেম্বর ২০২০।

‘তারাদের শেষ তর্পণ’ চতুর্থ এপিসোড দেখেছিলাম সেদিন। সেই দেখায় মূহ্যমানতার ঘোর কাটিয়ে উঠে আজ ফিরে দেখছি সব্বার অবশ্যদ্রষ্টব্য এই এপিসোডটিকে।এপিসোডটি শুরু হয়েছিল এক সুদূর প্রসারী ট্রেনভ্রমণের ‘গল্প হলেও সত্যি’ দিয়ে।

তখন ভারতীয় দলে ঢোকার দরজায় সজোরে ধাক্কা দিচ্ছিলেন বাঙালি তরুণ গোপালকৃষ্ণ বসু। ২৫-২৮ অক্টোবর ১৯৭৪ অবশিষ্ট ভারতীয় একাদশ ইরাণী ট্রফি ফাইনাল খেলেছিল কর্ণাটকের বিরুদ্ধে, আমেদাবাদে।সে ম্যাচে তিনি করেছিলেন ৬২ আর ১০০। উল্লেখ্য, তখন অবশিষ্ট ভারতীয় একাদশে ওপেনার ছিলেন গোপাল বসু আর ১০ নম্বরে নামতেন মহিন্দর অমরনাথ।

আহমেদাবাদ থেকে বোম্বাইতে ফেরার সময়ে ট্রেনে একটি ক্রিকেট বহির্ভূত ঘটনায় (‘সিগারেটের মুখে আগুন’ না দেওয়াজনিত) জড়িয়ে যান অবশিষ্ট ভারতীয় একাদশের অধিনায়ক মনসুর আলি খান পতৌদি আর গোপালকৃষ্ণ বসু। এরই জেরে কয়েক মাস পরে টিমে নিশ্চিত ১১ জনের দলে প্রথমবার নির্বাচিত গোপালকৃষ্ণ বসুকে টিম থেকে বাদ দিয়েছিলেন তখন ভারতীয় অধিনায়ক, তার বদলে একনাথ সোলকারকে টিমে ঢুকিয়ে টিমের তথাকথিত ‘কম্বিনেশন’ রক্ষা করে।

তার কয়েক মাস আগে ইংল্যান্ডে মার্ক অ্যান্ড স্পেনসারের আনা শপলিফ্টিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত সুধীর নায়েককে টিমে জায়গা করে দিতে গিয়ে টিমে নিশ্চিত গোপালকৃষ্ণ বসুকে টিমে নেননি অজিত ওয়াদেকার, না হলে সুধীর নায়েক নাকি আত্মহত্যা করতে পারতেন। টিমে নিশ্চিত, কারণ ১৯৭৩-৭৪ ইরাণী ট্রফিতে বোম্বাইয়ের (তখনও মুম্বাই জন্মায়নি) বিরুদ্ধে অবশিষ্ট ভারতের হয়ে অপরাজিত ম্যারাথন ১৭৪ রান প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটের পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছিল এই সোজাসাপ্টা স্পষ্টভাষী বাঙালী ওপেনার-ক্রিকেটারকে।

এবং তার পরেই তিনি নির্বাচিত হন ভারতীয় দলের ওপেনার হিসেবে শ্রীলঙ্কা সফরে ‘বেসরকারি টেস্ট’ (তখন অনুরা টেনিকুনের নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কা সরকারী টেস্ট দল হিসেবে গণ্য হতনা) দলে। তিনি শ্রীলঙ্কায় বেসরকারি টেস্টে খেলেওছিলেন। এবং ওপেন করতে নেমে সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে ১৯৪ রান যোগ করেছিলেন। পেয়েছিলেন শতরানও।ঐ ম্যাচের কথা এই এপিসোডে শোনালেন সঞ্চালক ছাড়াও গোপাল বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক-সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত।

তারপর আরও বড় ‘অপরাধ’ করেন স্বাধীনচেতা সোজাসুজি গোপালকৃষ্ণ বসু। ইংল্যান্ড ট্যুরের বকেয়া ভাতা চেয়ে বসেন তৎকালীন বোর্ডের হর্তাকর্তা পুরুষোত্তমলাল রুংতার অত্যন্ত এক প্রিয়পাত্র তখনকার বোর্ড কোষাধ্যক্ষর কাছে। তার মত জুনিয়ারের সেই ‘দুঃসাহস’ পৌঁছে যায় রুংতাজীর কানে। আর ঐ কাজের জন্য গোপাল বসুকে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেন রুংতাজী এবং তা অমান্য করায় লেখা হয়ে যায় গোপাল বসুর টেস্ট খেলার সম্ভাবনার ‘এপিটাফ’।

আর কোনদিন টেস্ট খেলা হয়নি মাত্র একটি ওডিআই-তে ভারতের ক্যাপ পাওয়া কলকাতার গোপালকৃষ্ণ বসুর এবং বছর তিনেক পরে ক্রিকেট থেকেই অবসর নিয়ে নেন মাত্র ৩১ বছর বয়সে, একটি বেসরকারি টেস্ট শতরান করে, একটি ওয়ানডে খেলে এবং ৭৮টি ম্যাচে ৩৭৫৭ রান আর ৭৮টি উইকেট অর্জন করে। ২০১৬ সালে গোপাল বসু এই এপিসোডের সঞ্চালককে বলেছিলেন, আজ খেলা শুরু করলে, ‘মুখ বন্ধ করে ক্রিকেট খেলতাম।’ শচীন বা সানির লেভেলের ক্রিকেটার না হলে ভারতীয় ক্রিকেটে কথা বলার অধিকার কারোর নেই বলেও মত দিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু গোপাল বসু ক্রিকেটকে ছাড়লেও ক্রিকেট গোপাল বসুকে ছাড়েনি। আশির দশকে কোচিংয়ে এসে অনবদ্য সব ছাত্র তৈরী করেছেন তিনি। সোজা থাকার আর সততার সঙ্গে পজিটিভলি খেলার শিক্ষা দিয়ে গেছেন তাদের, যাদের অন্যতম হলেন অধুনা অভিনেতা যীশু সেনগুপ্ত। সোচ্চার স্মৃতিচারণে অকপট যীশুর মুখে এটাই অনুযণিত হচ্ছিল।

পজিটিভনেসের কথাই বললেন জয়দীপ মুখার্জীও। দেবাং গান্ধীর কথায় আশির দশকে নিয়মানুবর্তী কোচ গোপাল বসু ফুটে উঠেছেন বারে বারে। রণদেব বসু, শরদিন্দু মুখার্জী তার কোচিংয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাদের মোহময় অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। দেবাং গান্ধী, শরদিন্দু মুখার্জী, রণদেব বসু, লক্ষ্ণীরতন শুক্লার মত চারজন ভারতীয় খেলোয়াড় তৈরীর রূপকার ছিলেন গোপাল বসু।

বাংলার সৌরাশিস লাহিড়ী, শিবসাগর সিংও ছিলেন তারই হাতেগড়া। নিজের ক্রিকেটজীবনে পাওয়ার বঞ্চনার কথা সরিয়ে রেখে একরোখা, জেদী কিছু ছাত্র তৈরী করে গেছেন গোপাল বসু। এই এপিসোডে ডকুমেন্টেড আছে যে, তার স্মৃতিসভায় বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন সৌরাশিস লাহিড়ী ও রণদেব বসু।নব্বইর শেষে সুপ্রতিষ্ঠিত সৌরভ গাঙ্গুলির ভুলত্রুটিও তারই অনুরোধে ঠিকঠাক করে দেবার রাস্তা দেখাতেন প্রখর ক্রিকেট প্রজ্ঞাবান গোপাল বসুই।

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপজয়ী শ্রীলঙ্কার কোচ ডেভ হোয়াটমোরও পরে একবার গোপাল বসুর ‘নোটবুক’ চেয়ে নিয়েছিলেন।সাংবাদিক-পরিসংখ্যানবিদ-লেখক বোরিয়া মজুমদারের মতে, তখন জগমোহন ডালমিয়া থাকলে গোপাল বসু এত বড় অবিচারের শিকার হতেন না। ফোনে গোপাল বসুর ব্যাটিংয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন লিজেন্ড গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথও। সুনীল গাভাস্কারের গোপাল বসুকে নিয়ে গভীর আস্থার কথাও ধরা আছে এই এপিসোডে।

টেকনিকাল বিশ্লেষণে অনবদ্য ক্রিকেট লেখক গোপাল বসুর কাছেও কৃতজ্ঞ থেকে গেছেন বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীরা। অনুলিখনের ধারকাছ দিয়ে কোনদিন না হেঁটে নিজে লিখতেন, ঝরঝরে সুখপাঠ্য ইংরেজী ও বাংলায় লিখতেন। অশোক দাশগুপ্তর তার লেখার বিমুগ্ধতায় ঢাকা পড়ে যাওয়া ধরা আছে এই এপিসোডে, দলিলের মত। একইভাবে দেবাশিস দত্তও তার লেখার কাছে নতজানু থাকার কথা বলে গেছেন মুগ্ধ হয়ে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে।

এই এপিসোডের সঞ্চালক তাকে বললেন ক্রিকেট সাংবাদিকদের ‘সিধুজ্যাঠা’। ক্রিকেট নিয়ে তার প্রখর পড়াশুনো ছিল তার সম্পদ। সাফল্য পাওয়া লিজেন্ডদের জীবনী থেকে লেখা ও কোচিংয়ের রসদ খুঁজে নিতেন তিনি।এই এপিসোডে সশ্রদ্ধ স্মৃতিচারণে অকপট সহধর্মিণী নিবেদিতা বসু বারবার বলে গেছেন নিষ্ঠাবান, নিবেদিত এক নির্লোভ, সরল, নাছোড় ক্রিকেটসন্ন্যাসী গোপাল বসুর কথা। বাবাকে নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছেন তার ছেলে অরিজিত বসুও।

এই এপিসোডে নেই, কিন্তু তথ্য হল এই অরিজিত বসুই নভেম্বর ২০০০-এর ইডেনে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফির অভিষেক ম্যাচে বাংলার হয়ে ওপেন করে শতরান (১০১) করেছিলেন এবং সেই বাংলা দলের সদস্য ছিলেন সুনীল গাভাস্কারের ছেলে রোহন গাভাস্কার।

কিন্তু মালয়েশিয়ায় বিরাট কোহলির নেতৃত্বাধীন ২০০৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী অনূর্ধ্ব ১৯ ভারতের ম্যানেজার হিসেবে বিশ্বকাপ পদক অনেকটাই ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ দিয়েছিল ক্রিকেটার জীবনে চিরবঞ্চিত গোপাল বসুকে।ঐ পদকটি গোপাল বসুর বিশেষ গর্বর কারণ ছিল। তার অনেক ‘না পাওয়া’ ঢেকে দিয়েছিল ঐ পদকটি। অনেক বাঘা ভারতীয় ক্রিকেটারের যা ছিলনা, সেই বিশ্বকাপ পদক পেয়েছিলেন তিনি।

তার ফিল্মের পর্দার গুরু দেবানন্দ ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দাহর পরে সমাহিত হন মধ্য লন্ডনের পাটনি রেল ক্রিমেটোরিয়ামে। তার ৯ বছর পরে ২০১৬ সালে এটা জেনে গোপাল বসু এই এপিসোডের সঞ্চালককে বলেছিলেন আগাগোড়া সাহেবীয়ানা মানসিকতার দেব আনন্দের এটা প্রাপ্যই ছিল।

ইতিহাসের পরিহাস এই যে, এর দু বছর পরে গোপাল বসু নিজেই বার্মিংহামের একটি ক্রিমেটোরিয়ামে দাহর পরে সমাহিত হন। যার কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এই এপিসোডের সঞ্চালক আর দেবাশিস দত্ত।গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল ঐ অংশটা দেখতে আর শুনতে গিয়ে। অদিতি গুপ্তর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ এর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে।

একদম শেষে বলা সঞ্চালকের বলা কথাগুলো বোঝানো আমার দ্বারা হবেনা। ওটা দেখে নেবেন সবাই।ঐ কথাগুলো শুনতে শুনতে চোখের কোণটা অজান্তেই ভিজে যাবে, তৈরী থাকবেন।এই কান্নাটাই আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের কর্ণ গোপাল বসু আর যিনি এই এপিসোডটা উপস্থাপনা করে কাঁদিয়ে দিলন, তাঁর নাম গৌতম ভট্টাচার্য। হ্যাঁ তিনিই এই এপিসোডের সঞ্চালক। ‘তারাদের শেষ তর্পণ’-এর এই এপিসোডটা আসলে ছিল তর্পণের পরে মাথা নীচু করে করা ‘ইন্ট্রোস্পেকশন’, যেখান থেকে আর মাথা তুলতেই ইচ্ছে করেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link