২০০৭ সালের মার্চ! চৈত্র মাসের উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। সেই সাথে দেশের অগণিত ক্রিকেটভক্তের মাঝে বাড়তি উত্তাপ যোগ করতে থাকে নবম ক্রিকেট বিশ্বকাপ। বিশ্বের প্রতিটি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের মতো বাংলাদেশেও কাজ করছিল বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উত্তেজনা। কারণ মার্চের ১৩ তারিখ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে শুরু হতে যাচ্ছিল ক্রিকেটের এই মহোৎসব।
আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ফেব্রুয়ারিতেই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পাড়ি জমায় বাংলাদেশ। মার্চের ১৭ তারিখ ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে তাঁদের বিশ্বকাপ মিশন। প্রথম ম্যাচকে ঘিরে তাই চলছিল হাবিবুল বাশারদের জোর প্রস্তুতি। তাছাড়া এর আগের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল একেবারে যাচ্ছেতাই।
সেবার একটি ম্যাচও জিততে পারেননি তাঁরা। এমন কি খর্ব শক্তির কানাডার বিপক্ষেও পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল তাঁদের। তাই এই বিশ্বকাপে নিজেদের সামর্থ্য জানান দেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন খেলোয়াড়রা যার প্রমাণ মেলে প্রথম ম্যাচেই। কারণ এর আগের বিশ্বকাপের রানার আপ ভারতকে হেসেখেলে হারিয়ে নবম বিশ্বকাপে শুভ সূচনা করে বাংলাদেশ।
অথচ ভারতকে হারানোর কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। শুধু প্রতিপক্ষের শক্তির বিচারেই নয়, তখন বাংলাদেশ দলের সার্বিক পরিস্থিতির সাপেক্ষেও ভারতের মতো দলের বিপক্ষে মাঠে আধিপত্য বিস্তার করে ম্যাচ জেতাটা ছিল অনেকটা অপ্রত্যাশিত। কেননা ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে বিরাট এক ধাক্কা খেয়ে বসে বাংলাদেশ।
ম্যাচের আগের দিন হঠাৎ দেশ থেকে অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের কাছে ফোন আসে। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে তাঁদেরই সতীর্থ মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যু সংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে যেন থমকে দাঁড়ায় পৃথিবী।
মুহূর্তেই খুলনার কার্তিকডাঙ্গা থেকে শোকের মাতম ছড়িয়ে পড়ে পোর্ট অব স্পেনে। বাংলাদেশ শিবিরে নেমে আসে শোকের ছায়া। এক সমুদ্র জল জলোচ্ছ্বাসের মত উথলে ওঠে সবার চোখে। সবারই মেনে নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল বিষয়টা। কারণ দলের সবারই যে অত্যন্ত প্রিয়মুখ ছিলেন এই রানা!
পরদিন ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আগ মুহূর্তে রানার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় পোর্ট অব স্পেইনে। ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিটি খেলোয়াড় কালো আর্মব্যান্ড পরে মাঠে নামেন। রানার অকালমৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে সেদিন তারকাখচিত ভারতকে ঠিকই পর্যুদস্ত করে বাংলাদেশ। রানার জন্য কিছু একটা করার তাগিদে ক্ষুধার্ত বাঘেরা এই জয়কে উৎসর্গ করেন তাঁদেরই হারিয়ে যাওয়া সেই প্রাণপ্রিয় সতীর্থকে।
মানজারুল ইসলাম রানা ছিলেন প্রচণ্ড হাসিখুশি একজন মানুষ। সাজঘর মাতিয়ে রাখার ব্যাপারটা ছিল তাঁর নখদর্পণে। অগ্রজ, অনুজ সবার সাথেই ছিল খুব ভালো সম্পর্ক। তখনকার বাংলাদেশ দলের কোচ ডেভ হোয়াটমোরেরও অন্যতম পছন্দের শিষ্য ছিলেন তিনি।
রানা ছিলেন মনেপ্রাণে একজন ক্রিকেটার। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ক্রিকেট-উন্মাদ। স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে ক্রিকেটার হবার। তখন রাতে বিছানায় ব্যাট-বল নিয়ে ঘুমানোর ঘটনা তাঁর ক্রিকেট পাগলামিরই একটি অংশ।
দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি পার করতেন মাঠে ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে। তাছাড়া রানা শুধু মাঠেই বোলিং করতেন না। রাস্তাঘাট এমন কি ঘরেও হাত ঘুরাতেন। রাস্তায় চলার সময় কিংবা বাসায় অবসরে খালি হাতেই একের পর এক ডেলিভারি দিতে থাকতেন তিনি।
ক্রিকেটের নেশায় সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকায় মায়ের কাছ থেকে অবশ্য কম বকুনি খেতে হয়নি রানাকে। তারপর মা নিজেই একটা সময় ছেলের এই পাগলামির কাছে হার মানেন। রানার মতো তিনিও একসময় স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন ছেলেকে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে দেখার।
মা-ছেলের সে স্বপ্ন পূরণ হয় ২০০৩ সালে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গনে পথচলা শুরু করেন মানজারুল ইসলাম রানা। আর অভিষেক ম্যাচ খেলতে নেমেই একটি রেকর্ডের মালিক বনে যান তিনি। নিজের করা তৃতীয় বলে মাইকেল ভনকে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ওভারেই উইকেট তুলে নেওয়ার রেকর্ড গড়েন রানা।
যদিও অভিষেক ম্যাচে রেকর্ড করার পর অভিষেক সিরিজে বলার মতো তেমন কিছুই করে দেখাতে পারেননি তিনি। তিন ম্যাচের ওই সিরিজে ব্যাট হাতে রানার সংগ্রহ ৪৬ রান এবং বল হাতে মাত্র ১টি উইকেট। ঠিক এর পরের সিরিজেই টেস্ট অভিষেক হয়ে যায় তাঁর। ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকের পর একই বছর চারটি টেস্ট খেলে দল থেকে বাদ পড়ে যান রানা।
তারপর আর কোনো টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়নি তাঁর। মাত্র ৬ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে ২৫.৭০ গড়ে তিনি সংগ্রহ করেন ২৫৭ রান এবং বোলিংয়ে ৮০.২০ গড়ে সংগ্রহ করেন ৫টি উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটের এই ছোট্ট ক্যারিয়ারে অবশ্য একটি রেকর্ডের অংশীদার ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাঁর ও হাবিবুল বাশারের ১২০ রানের জুটিটা ছিল এক সময় চতুর্থ উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ।
টেস্ট অভিষেকের মাত্র ১০ মাসের মধ্যে দল থেকে বাদ পড়লেও ওয়ানডেতে নিয়মিত খেলে যাচ্ছিলেন রানা। ওয়ানডেতে নিজের সেরা খেলাটা তিনি খেলেন ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোম সিরিজে। ওই সিরিজের তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যাচে টানা ম্যাচ সেরার পুরস্কার পান তিনি।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওই সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হেরে সিরিজ হারের শঙ্কায় পড়ে বাংলাদেশ। সিরিজ রক্ষার তৃতীয় ম্যাচে রানার ক্যারিয়ার সেরা ৩৪ রানে ৪ উইকেট ও ৪র্থ ম্যাচে ৩৬ রানে ৪ উইকেট বাংলাদেশকে সিরিজ হারের কবল থেকে রক্ষা করে।
পরবর্তীতে শেষ ম্যাচটি জিতে ৩-২ এ সিরিজ জয় নিশ্চিত করেন তাঁরা। এটি ছিল ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম কোনো ওয়ানডে সিরিজ জয় যেখানে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল মানজারুল ইসলাম রানার।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২৫ ম্যাচ খেলে ২০.৬৮ গড়ে রানা সংগ্রহ করেন ৩৩১ রান যেখানে রয়েছে একটি অর্ধশতক। আর বোলিংয়ে ২৯.৯৫ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ২৩ উইকেট।
২০০৫ সালের জিম্বাবুয়ে সিরিজের পরের কয়েকটি সিরিজে সাদামাটা পারফরম্যান্স করায় একাদশে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকেন রানা। তারপর ২০০৬ সালে ঘরের মাঠে কেনিয়ার বিপক্ষে চার ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচটি খেলে দল থেকে বাদ পড়ে যান তিনি।
সেই যে বাদ পড়া তারপর আর কখনোই দলে ফেরা হয়নি তাঁর। আর ফিরবেনইবা কী করে! জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার এক বছরের মধ্যে যে পৃথিবী থেকেই বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় তাঁর।২০০৭ সালের আজকের এই দিনে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে যায় মাত্র ২২ বছর বয়সী রানার জীবনপ্রদীপ।
দেখতে দেখতে চৌদ্দটি বছর কেটে গেল রানা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছেন। হয়তো এখন স্বর্গের সবুজ গালিচায় বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বাইশ গজে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন রানা। হয়তো তাঁর বাঁ-হাতের ভেলকিতে ব্যাটসম্যানরা খাবি খাচ্ছেন। নিশ্চয়ই মজা করে তিনি মাতিয়ে রাখছেন স্বর্গের সবাইকে।
রানার খালি হাতে বল করার দৃশ্য দেখে হয়তো গগণফাটা হাসিতে মেতে ওঠছেন স্বর্গের বাকিরা। তাঁর এই ক্রিকেট পাগলামিকে নিশ্চয়ই স্বর্গের অন্যান্যরা বেশ উপভোগ করছেন।
হয়তো স্বর্গে বসেই তিনি দেখছেন প্রিয় বন্ধু মাশরাফিকে। দেখছেন নিজের মতো বাঁ-হাতি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে যিনি বিশ্বসেরার মুকুট মাথায় নিয়ে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। হতে পারে মাশরাফির মতো কাউকে ইতোমধ্যে স্বর্গে পেয়েও গেছেন। বন্ধু বানিয়ে যার সাথে তিনি নিয়মিত গল্প করেন বিশ্বসেরা সাকিবের, গল্প করেন মাশরাফির এবং বাংলাদেশ দলের একেকটি সাফল্যের।
ছোট্ট ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ব্যক্তিগতভাবে কেবল দুয়েকটা রেকর্ড করতে পারা রানা রেকর্ড করে গেছেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার মধ্য দিয়েও। কারণ তিনিই সবচেয়ে কম বয়সী টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছেন। রানার এই রেকর্ডে এখন পর্যন্ত আঁচড় কাটতে পারেননি কেউ।
রেকর্ড তো গড়াই হয় ভাঙার জন্য। তাই রানার আগে টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার আর্চি জ্যাকসনের সবচেয়ে কম বয়সে মৃত্যুর রেকর্ডটা যে ভাঙারই ছিল। কিন্তু সেই রেকর্ড কেন আমাদের রানাকেই ভাঙতে হল?
এমন একটা রেকর্ডের সাক্ষী হতে তো আমরা কেউই চাইনি। এমন রেকর্ড আমরা কখনোই চাইনি যা আগামীতে আরো অনেক রেকর্ড গড়ার সম্ভাবনাকে চিরতরে নিষ্পেষ করে দেয়। চাইনি আমরা বিধাতার এমন নিষ্ঠুরতা।