২০০৭ সালের পর ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে এজবাস্টনে ইংল্যান্ড পঞ্চম টেস্টটি সাত উইকেটে জিতে নিয়েছে। গেল বছর শুরু হওয়া পাতৌদি ট্রফির ফলাফল তাহলে দাড়ালো ২-২ তে ড্র।
গত বছর ঝুলে থাকা ভারত বনাম ইংল্যান্ডের পঞ্চম টেস্ট ম্যাচটি এ বছর মাঠে গড়িয়েছে। করোনার জন্য গত বছর শেষ টেস্টটি না খেলেই দেশে ফিরে যেতে হয়েছিল কোহলিদের। তখন অব্দি চার টেস্ট শেষে একটি ড্র সহ ভারত ২-১ ব্যবধানে সিরিজটি এগিয়ে ছিল। সিরিজ জয়ের জন্য তাই শেষ টেস্টটি ভারতের জয় বা ড্র করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডের শক্তিশালী ব্যাটিং অর্ডার ও সাবেক অধিনায়ক জো রুট ও জনি বেয়ারস্টো ফর্মে থাকায় তাদের টেস্টটি জয়ের পরিকল্পনাই ছিল। হয়েছেও তাই।
এই ইংলিশ ব্যাটারের অসাধারণ দুইটি সেঞ্চুরির বদৌলতে ইংল্যান্ড ভারতের দেয়া ৩৭৮ রানের টার্গেট অনায়াসে তাড়া করে ম্যাচটি নিজেদের করে নেয়। চতুর্থ ইনিংসে জো রুট ১৪২ রান ও জনি বেয়ারস্টো ১১৪ রান করেন। বেন স্টোকস এর দলটি ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে এই জয় ছিনিয়ে নেয়।
কিন্তু ভারতের বেলায় ঋষভ পান্ত ও রবীন্দ্র জাদেজা ছাড়া তেমন কোন ব্যাটার বস্তুত নজরকাড়া পারফর্মেন্স দেখাতে পারেননি। পান্ত এই টেস্টে ২০৩ রান করেন, অর্থাৎ গড়ে প্রতি ইনিংসে ১০১.৫০ রান করেছেন তিনি। আর জাদেজা ১২৭ রান করেন যেখানে ইনিংসপ্রতি তিনি ৬৩.৫০ রান করে ভুমিকা রেখেছেন।
এই টেস্টে রেগুলার ওপেনার ও ক্যাপ্টেন রোহিত শর্মা কোভিড পজিটিভ ছিলেন বলে খেলেন নি। এদিকে কুঁচকির অপারেশনের কারণে কে এল রাহুলও অনুপস্থিত। যার কারণে চেতেশ্বর পুজারাকে শুভমান গিলের সাথে মিলে ওপেনিংয়ে নামতে হয়েছে। হনুমা বিহারি নেমেছেন তিনে এবং বিরাট কোহলি চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছেন। কিন্তু বিরাট নিজেও ফর্মে ফিরতে পারছেন না।
সব মিলিয়ে আসলে এই চারজন টপ অর্ডার ব্যাটারের কেউই আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারেন নি। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে পুজারা ৬৬ রান করেছে যদিও তাঁর থেকে আরও ভালো ভুমিকার আশা ছিল। বিশেষ করে কাউন্টি ক্রিকেটে সাসেক্স এর হয়ে চারটি টানা সেঞ্চুরির মতো অভাবনীয় পারফরমেন্স এর পর ভারত তাঁর থেকে আরও কিছু আশা রেখেছিল।
রাহুল দ্রাবিড়কে এখন প্রধান কোচ হিসেবে টপ অর্ডার ব্যাটারদের এমন রান খরার ব্যাপারটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে এবং এই সমস্যাটির সমাধান করতে হবে। গত এক বছরে এই চার টপ অর্ডার ব্যাটারের পারফরমেন্স কেমন ছিল – চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। স্কুলের রিপোর্ট কার্ডের কথাতো শুনেছেনই, এবার একটু ক্রিকেটারদের রিপোর্ট কার্ড বানানো যাক।
- শুভমান গিল (ওপেনার)
টেস্টে যেকোন দলের শক্তপোক্ত অবস্থানের জন্য ওপেনারের ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজবাস্টনে শুভমান গিলের শুরুটা ভালোই ছিল, কিন্তু অভিজ্ঞ জেমস অ্যান্ডারসন তাঁকে দ্রুতই মাত্র ১৭ রানে সাজঘরে পাঠিয়ে দেয়। দ্বিতীয় ইনিংসেও মাত্র চার রান করেই আউট হয়ে যান তিনি। কিন্তু দুই ইনিংসেই তাঁর উইকেটের ধরন একই ছিল। এন্ডারসনের ডেলিভারিতে ক্রলির মুঠোতে বন্দী হয়ে।
২২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার গত বছরে মাত্র তিনটি টেস্ট খেলেছেন, দুটি ঘরের মাঠে ও একটি ভিনদেশের মাটিতে। সব মিলিয়ে তিনি তিন টেস্টে ২৭.৫০ গড়ে ১৬৫ রান করেছেন, যার মধ্যে একটি হাফ-সেঞ্চুরি আছে। শুভমান বর্তমানে ওপেনিংয়ের জন্য ভারতের প্রথম পছন্দ, কিন্তু টিকে থাকতে হলে তাঁকে ধারাবাহিকভাবে রান করে যেতে হবে।
- চেতেশ্বর পূজারা (ওপেনার)
চেতশ্বর পূজারা এবার এজবাস্টন টেস্টে ভারতের অন্যতম ভরসার জায়গায় ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাজে পারফরমেন্স এর পর কাউন্টি ক্রিকেটে তাঁর পারফরমেন্স বেশ আশা যুগিয়েছিল, যে তিনি ফর্মে ফিরে এসেছেন। কারণ কাউন্টি ক্রিকেটে টানা চারটি সেঞ্চুরির চমক দেখিয়েছিলেন তিনি।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় ইনিংসে তিনি যদিও তিনি সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন, কিন্তু তার অবদান তেমন ফলপ্রসূ ছিলনা। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুজারার পারফরমেন্স হতাশাজনক ছিল। গত এক বছরে তিনি মোট দশটি ম্যাচ খেলেছেন যার মধ্যে দুইটি ভারতে এবং বাকী আটটি ম্যাচ দেশের বাহিরে হয়েছিল। দশটি টেস্টেই তিনি বিশ ইনিংসে ব্যাটিং করে মাত্র ২৭.৬৩ গড়ে ৫২৫ রান করেছেন। যার মধ্যে চারটি হাফ-সেঞ্চুরি রয়েছে।
- হনুমা বিহারি (৩ নম্বর ব্যাটার)
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারত শেষ যে টেস্ট সিরিজটি জিতেছিল, সেখানে হনুমা বিহারি দারুণ অবদান রেখেছিলেন। যার কারণে সবার প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের সাথে টেস্টেও তাঁর থেকে তেমন নায়কোচিত ব্যাটিং এর প্রত্যাশা ছিল।
কিন্তু আফসোস ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমণ সামলাতে পারলেন না তিনিও। দুই ইনিংস মিলিয়ে মাত্র ৩১ আন করেছেন তিনি। গত এক বছরে বিহারি দুইটি ঘরে ও দুইটি বাহিরে করে মোট চারটি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছেন। ৩৫.৮৩ গড় রাং রেটে তিনি মাত্র ২১৫ রান করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর ঝুলিতে এক বছরে মাত্র একটি অর্ধশতক রয়েছে।
- বিরাট কোহলি (৪ নম্বর ব্যাটার)
ভারতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক অনেক দিন ধরে ফর্মে নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোহলির শেষ সেঞ্চুরিটি ছিল সেই ২০১৯ সালের নভেম্বরে। তাঁর ক্যারিয়ার টেস্ট গড় ৪৯.৫৩ আদতে ভালো মনে হলেও, গত এক বছরে তাঁর পারফরম্যান্স বেশ হতাশাজনক ছিল।
গত বছর টেস্টে তাঁর গড় ৩০ এর নিচে নেমে গেছে। গত এক বছরে দশটি টেস্টে সর্বমোট তিনি আঠারোবার ব্যাট ধরার সুযোগ পেয়েছেন। যার মধ্যে তিনটি টেস্ট ছিল ঘরের মাঠে আর সাতটি টেস্ট ছিল ভিনদেশের মাটিতে। তিনি মাত্র ২৯.২৭ গড়ে আঠারো ইনিংসে মাত্র ৫২৭ রান করেছেন। এবং মাত্র তিনটি অর্ধশতক থাকলেও গত এক বছরে তাঁর ঝুলিতে কোন সেঞ্চুরি নেই। অথচ ভারতের অন্যতম ব্যাটিং রাজা কোহলির কাছ থেকে এজবাস্টনে সবাই ফর্মে ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তিনি আশাহত করলেন আরেকবার।
টেস্টে ভারতের আশানুরূপ সাফল্য পেতে হলে টপ অর্ডার ব্যাটারদের ফর্মে ফিরতে হবে, ভালো রান তুলতে হবে। তবেই তো দল একটা শক্তপোক্ত অবস্থানে যাবে।