তাঁকে বলা হয় ক্রিকেটে আধুনিক ফিল্ডিংয়ের রূপকার। যিনি পয়েন্ট আর ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টটাকে বানিয়ে ফেলেছিলেন তার নিজস্ব জায়গা। হ্যাঁ, সাবেক প্রোটিয়া তারকা ক্রিকেটার জন্টি রোডস।
জন্টি রোডস- নামটি শুনলেই আপনার মানসপটে ভেসে উঠবে বাজপাখির মতো ক্ষিপ্রতায় তার বলকে মুঠো-বন্দী করার দৃশ্য।
প্রতিযোগিতামূলক আধুনিক ক্রিকেটে শুধুমাত্র ‘ফিল্ডার’ কোটায় কেউ একজন খেলোয়াড়কে বয়ে বেড়াবে এমনটা ভাবনাতেও আনা দুষ্কর। নাহ, জন্টি রোডসের বেলায়ও এমনটা করেনি তার দল দক্ষিণ আফ্রিকা। ডানহাতি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলা রোডসকে দলে টিকে থাকতে হয়েছে ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েই। আবার ফর্মহীনতায় জায়গা হারাতে হয়েছিল দল থেকেও।
১৯৯৬ সালে টানা ছয় ইনিংসে ব্যর্থতার পাশাপাশি মোটা দাগে ধরা পড়েছিল তার অফ সাইডের বল খেলার দূর্বলতা। ফলশ্রুতিতে বাদ পড়েছিলেন টেস্ট দল থেকে।
কঠোর পরিশ্রম আর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করে রোডস ফিরেছিলেন ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইংল্যান্ড সফরের টেস্ট দলে। মাঝখানের এই সময়টুকুতে রোডসের উপর ভরসা রেখেছিলেন একজন। তিনি তখনকার প্রোটিয়া অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়ে। দলে ফিরে অধিনায়কের এই আস্থার প্রতিদানও দারুণভাবেই দিয়েছিলেন রোডস।
প্রত্যাবর্তনেই বার্মিহামে প্রথমে টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৫৬ বলে ৯৫ রানের অনবদ্য এক ইনিংস; ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ঐ ইনিংসের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। কিন্তু জন্টি রোডসের নিজেকে প্রমাণ করার যে তখনো বাকি।
তিনি তার ব্যাটিং সামর্থ্যের সবচেয়ে বড় প্রমাণটা বোধহয় রেখেছিলেন পরের টেস্টে ঐতিহাসিক লর্ডসে। সেদিন টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নামা প্রোটিয়াদের টপ অর্ডারকে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন ইংলিশ পেসার ডমিনিক কর্ক।
জন্টি রোডস যখন ব্যাটিংয়ে আসেন তখন প্রোটিয়াদের স্কোরবোর্ড ৪৬-৪। পেস বোলারদের পয়মন্ত ইংলিশ আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে বোলিং প্রান্তে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আছেন কর্ক-ফ্রাসাররা। উইকেটে থাকা দলপতি হ্যান্সি ক্রোনিয়ে তখন পরিকল্পনা আটলেন খোলস থেকে বেরিয়ে পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার।
কিন্তু বিধিবাম!
আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে ডিন হেডলির প্রথম ওভারেই স্লিপে ক্যাচ তুলে দেন রোডস, তবে
বেঁচে যান মাইক আথারটনের বদান্যতায়। হাডলির পরের ওভারে ফের আথারটনের হাতেই ক্যাচ তুলে দেন রোডস। এবার আথারটন ভুল না করলেও ভুলটা করেছিলেন খোদ হারডিল। নো-বলের কল্যাণে এবারও বেঁচে যান রোডস। ঐ ইনিংসে এরপরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রোডসকে। লর্ডস টেস্টটাই ছিল জন্টি রোডসময়।
শুরুর ঐ ধাক্কাটা সামলে হ্যান্সি ক্রনিয়েকে নিয়ে অবিচ্ছিন্ন থেকে প্রোটিয়াদের ইনিংসকে নিয়ে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় দিনে। ১৮৪ রানের জুটি গড়ে পঞ্চম উইকেটে জন ওয়াইটে ও টনি পিথের রেকর্ড ভেঙ্গে এই দুজন গড়েছিলেন প্রোটিয়াদের হয়ে নতুন রেকর্ড। আউট হওয়ার সময় রোডসের প্রতি অধিনায়কের বার্তা ছিল যতদূর সম্ভব ইনিংসটাকে এগিয়ে নেয়া। সে কাজটাও রোডস সামলেছিলেন যথার্থভাবেই।
ক্রোনিয়ে আউট হওয়ার পর শন পোলক ও মার্ক বাউচারকে নিয়ে স্কোরবোর্ডে আরো ৫৩ রান যোগ করেন রোডস। পাশাপাশি চাপের মুখে তুলে নেন অনবদ্য এক সেঞ্চুরিও। ক্ষিপ্র গতিতে দৌঁড়ে তিন রান নিয়ে শতরানের মাইলফলকেও রোডস পৌঁছেছিলেন তার নিজস্ব ঢংয়ে।
১৪ টি চার আর একটি ছয় হাঁকিয়ে ২৯৬ মিনিট উইকেটে থেকে ২০০ বল মোকাবেলা করে টেস্ট ক্যারিয়ার সেরা ১১৭ রান করে রোডস যখন আউট হলেন তখন তার দল স্কোরবোর্ডে পেয়ে গেছে লড়াইয়ের এক শক্ত ভিত। সে ভিতের উপর দাঁড়িয়েই ঐ টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা ইংলিশ মুলুকেই ইংলিশদের পরাজিত করে ১০ উইকেটে।
লর্ডসে ঐ টেস্টে ম্যাচ সেরার পুরস্কার উঠেছিল জন্টি রোডসের হাতেই। ম্যাচ সেরার পুরষ্কারের পাশাপাশি ওই টেস্টে আরো একটা স্বীকৃতিও জুটেছিল রোডসের ঝুলিতে। খেলা শেষে অ্যালান ডোনাল্ড কিংবা প্যাট সিমকক্স; কিংবদন্তির কোন একজন তাকে উদ্দেশ্য করে লিখে দিয়েছিলেন, ‘জন্টি রোডস; শুধুমাত্র একজন ফিল্ডারই নন!’
৫২ টেস্টে ৩৫.৬৬ গড়ে ২৫৩২ রান এবং ২৪৫ ওয়ানডেতে ৩৫.১১ গড়ে ৫৯৩৫ রান।
বিশ্বের অনেক স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের তুলনায় পরিসংখ্যানটা নিতান্ত খারাপ নয়। এর সাথে প্রতি ম্যাচে এক গাদা রান সেভ, জনা দুয়েক ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দেওয়া যোগ করে নিন। বুঝতে পারবেন তিনি আসলেও সর্বকালের ফিল্ডারের চেয়ে একটু বেশি কিছু।