স্বপ্ন দেখানো দুরন্ত কলিন্স

সেই যে স্বপ্নটা দেখতেন নাইরোবির জিমখানা মাঠ, বিশ্বকাপের ম্যাচ, উইকেট নিয়ে ছুটছেন কলিন্স! নাহ ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০০৩ দিনটা আজন্ম ভুলবেন না কলিন্স। মহাশক্তিধর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২৪ রানে ৫টা উইকেট, স্বপ্ন তো সত্যি হলো। রাতে কী ঘুমোবেন না কলিন্স, নাকি আবার কোনো নতুন কোনো স্বপ্ন দেখবেন, সামনে তো সুপার সিক্স, তারপর সেমি ফাইনাল হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কলিন্স তবে স্বপ্ন ই দেখবেন, আবার যদি সত্যি হয়!

বাড়ির তিন ভাইই ক্রিকেটটা খেলেন, তার মধ্যে বড় জন কেনেডি তো বেশ নাম টাম করে ফেলেছেন, দেশের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোর কেনেডির নামেই, দলের উইকেট কিপিংয়ের দিকটাও তাঁকেই দেখতে হয়। মেজো ভাই ডেভিড ও কম যাচ্ছে না এখন, সেও কিপার ব্যাটসম্যান, ছোটটার আবার কিপিং টিপিং মোটেই পছন্দ নয়, কিপিং নয় দাদারাই করুক, ওদের বল করবে কে তাহলে?

তাঁর মনেপ্রাণে ইচ্ছে শেন ওয়ার্ন কিংবা আব্দুল কাদিরের মতো এক লেগ স্পিনার হওয়া। কিন্তু এ পোড়া দেশে সে কী পারবে? তেমন ক্রিকেট পরিকাঠামো উন্নত নয় তাদের, দিন রাত নাইরোবির জিমখানা মাঠে প্র্যাক্টিস করে যতটুকু হয়! ভালো যদি একটা কোচ ও পেতো! ব্যাটিং করতেও বেশ লাগে কলিন্স এর, কিন্তু লেগ স্পিন তার সবচেয়ে প্ৰিয়।

বিশ্বকাপের আগের বছরে যখন পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়া তাদের দেশে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে এসেছিলো তখন থেকেই চোখ টানছিল কলিন্স, বেশ ভালো টার্ন পাচ্ছিল তখন, আর বিদেশী মিডিয়াও বেশ প্রশংসা করে বলেছিল পরের বছরের বিশ্বকাপে এ ছেলের দিকে একটু চোখ রাখতেই হবে।

বিশ্বকাপের আসর সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবোয়ের সাথে কলিন্স এর নিজের দেশ কেনিয়াতেও, বেশি না গোটা দুয়েক ম্যাচ হওয়ার কথা, তার মধ্যে আবার নিউজিল্যান্ড এখানে খেলতে আসবে না নিরাপত্তার অভাবে, বলেই দিয়েছে। কলিন্স এর মনে হয় শ্বেতাঙ্গ দেশগুলোর যেন বেশি বাড়াবাড়ি, যাই হোক কেনিয়া তো পয়েন্ট পেয়েই যাবে না খেলে। এবার শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচ, আহ! কত্তো দিনের স্বপ্ন, শুধু কলিন্স নয় গোটা দলেরই, এই নাইরোবির জিমখানা মাঠে বিশ্বকাপ খেলবে। সেটা এবার পূর্ণ হতে যাচ্ছে।

লঙ্কা অধিনায়ক সনাথ জয়াসুরিয়া টসে জিতে ফিল্ডিং নিলেন, ভাবখানা এমন বাংলাদেশকে যেভাবে উড়িয়েছি তোদের ও সেভাবে ওড়াবো। ম্যাচের দ্বিতীয় বলেই ফিরে গেলেন রবিন্দু শাহ, তবে কী? এক প্রান্ত আগলে দাঁড়িয়ে গেলেন কলিন্স এর দাদা কেনেডি, চামিন্ডা ভাসের মতো বোলারকে স্লগ সুইপে মাঠের বাইরেও ফেললেন, ৬০ করে ফিরলেন কেনেডি, হিতেশ মোদি, ওদুম্বে আর পিটার ওনগোন্ড মিলে টেনেটুনে ২০০ পার করে দিলেন কেনিয়াকে, কলিন্স নিজে নট আউট ১৩ করে।

তবে যখন ব্যাট করছিলেন তখনই কলিন্স বুঝেছিলেন উইকেটটা বেশ স্লো, ছোট খাটো ক্র্যাক ও রয়েছে, ওদের মহামতি মুরলী তো জাদু দেখানো শুরু করেছিলেন, আজ কলিন্স কিছু করে দেখাতে পারবেন না? ছোট থেকে অনেক স্বপ্ন দেখেছেন যে, নাইরোবির জিমখানা মাঠ, বিশ্বকাপের ম্যাচ, উইকেট নিয়ে ছুটছেন কলিন্স। নাহ আজ পারতেই হবে।

অধিনায়ক টিকোলো যখন কলিন্স এর হাতে বল তুলে দিলেন লঙ্কান ব্যাটিং এর তখন ১৬ তম ওভার শুরু হবে, দুটো উইকেট পড়লেও এবার রীতিমতো গেঁড়ে বসেছেন হাসান তিলকরত্নে আর বারবার লঙ্কাকে উদ্ধার করে আসা সেই অরবিন্দ ডি সিলভা। দ্বিতীয় ওভারেই তিলকরত্নেকে টনি সুজির হাতে ক্যাচ তোলালেন কলিন্স, ‘দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক’ শুরু হলো বলে।

নতুন ব্যাটসম্যান মাহেলা জয়াবর্ধনের বিশ্বকাপটা এমনিতেই জঘন্য যাচ্ছে, সেটা আরও জঘন্য করে তুললেন কলিন্স এর টার্ন এ পুরোপুরি ঠকে গিয়ে তাঁর হাতেই ক্যাচ তুলে। ৪ উইকেট চলে গেছে লঙ্কানদের, উইকেট ক্রমশ স্লো হয়ে আসছে, আর হাত চাটছেন কলিন্স, স্বপ্ন সফল হবে তো! খানিক পরে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান ব্যাটসম্যান বলা হচ্ছে যাকে সেই সাঙ্গাকারা ও ফিরলেন দাদা কেনেডির হাতে ক্যাচ দিয়ে, বোলার? আবার কে – কলিন্স ই তো!

দাদা – ভাই এর কম্বিনেশনে উইকেট এলো, আহা বাড়িতে নিশ্চয়ই এখন সবাই টিভির সামনেই, ভাবতেই ভালো লাগছে কলিন্স এর। নাহ কাজ শেষ হয়নি এখন ও। ঐ অরবিন্দ যদি থাকে আর কিছুক্ষন, তাহলে স্বপ্নের জলাঞ্জলি হবে।
কলিন্স এর একখানা আপাত নিরীহ বল কাট করতে গিয়েছিলেন অরবিন্দ, ওমা একি টাইমিং হলো না তো! বল সোজা কিপার কেনেডির হাতে, কেনিয়ার ফিল্ডার দের সমবেত উল্লাসে আম্পায়ার রাসেল টিফিন তর্জনী তুলেছেন, বিশ্বাসই হচ্ছে না ডি সিলভার, কলিন্স এর ও বিশ্বাস হচ্ছে কী? ডি সিলভার উইকেট, উফফ।

স্বপ্ন না সত্যি!

লঙ্কানদের জিততে এখনও একশো রান বাকি, কফিনে পেরেক আর চারটে পুঁতলেই হবে। চাপ ক্রমশ জেঁকে বসছে শ্রীলঙ্কার ওপর, অসহ্য চাপের মুখে কলিন্স ওবুয়ার হাতে নিজেকে সমর্পন করে গেলেন চামিন্ডা ভাস ও। পঞ্চম উইকেটটা কলিন্স নেওয়ার পরে উল্লাসের বাঁধ ভাঙা শুরু এবার, উল্লাস শেষ করে আলতো করে একবার আকাশের দিকে তাকালেন কলিন্স, কাকে খুঁজলেন কে জানে! নাকি জিমখানা মাঠের পড়ন্ত সূর্যকে বোধহয় একবার দেখে নিলেন।

লঙ্কা ইনিংসের ল্যাজটা এবার ছাঁটার পালা। দিলহারা ফার্নান্দোকে বোল্ড করে আবেগে আত্মহারা হয়ে উঠলেন মরিস ওদুম্বে, সাত বছর আগে যার সোনার হাত ব্রায়ান লারাদের দুঃস্বপ্ন দেখিয়েছিলো, নাইরোবির জিমখানা মাঠও লঙ্কা বধ দেখে বাঁধ ভাঙা আনন্দে মেতে উঠেছে। আর সব কিছুর নায়ক – এতো বছর ধরে সেই স্বপ্নটাকে লালন করে আসা এক লম্বা ছিপছিপে তরুণ কলিন্স ওবুয়া।

সেই যে স্বপ্নটা দেখতেন নাইরোবির জিমখানা মাঠ, বিশ্বকাপের ম্যাচ, উইকেট নিয়ে ছুটছেন কলিন্স! নাহ ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০০৩ দিনটা আজন্ম ভুলবেন না কলিন্স। মহাশক্তিধর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২৪ রানে ৫টা উইকেট, স্বপ্ন তো সত্যি হলো। রাতে কী ঘুমোবেন না কলিন্স, নাকি আবার কোনো নতুন কোনো স্বপ্ন দেখবেন, সামনে তো সুপার সিক্স, তারপর সেমি ফাইনাল হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

কলিন্স তবে স্বপ্ন ই দেখবেন, আবার যদি সত্যি হয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...