প্রতিভার কী নিদারুণ অপচয়!

আট সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯ সাল। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট কোকাকোলা ট্রফি’র ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ভারত। টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে রাহুল দ্রাবিড়ের অপরাজিত সেঞ্চুরিতে (১০৩*) ভারত করেছিল ২৫৪ রান। এছাড়া ছয় নম্বরে নামা নিখিল চোপড়ার ব্যাট থেকে এসেছিল ৬০ বলে ৬১ রানের (৩×৪, ৩×৬) একটি দারুণ সময়োপযোগী ইনিংস।

ক্যারিবীয়দের পক্ষে সফলতম বোলার ছিলেন অফ স্পিনার নেহামিয়া পেরি (৩/৬৫)। তবে ভারতকে সাংঘাতিক চাপে রেখেছিলেন ফাস্ট বোলিং গ্রেট কোর্টনি ওয়ালশ। টেন্ডুলকারকে ০ রানে ফিরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি দুই মেডেনসহ ১০ ওভারে রান দিয়েছিলেন মাত্র ১৯!

এদিকে ২৫৫ রানের চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরু থেকেই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে উইন্ডিজ। দেবাশীষ মোহান্তি ও নিখিল চোপড়ার বোলিং তোপে ১৮ তম ওভারে মাত্র ৬৭ রান তুলতেই নেই চার উইকেট! সবচেয়ে বড় কথা, ইতিমধ্যেই প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছেন দলের প্রধান ভরসা, ‘বাঁ-হাতি জিনিয়াস’ ব্রায়ান চার্লস লারা (১৮)।

জয়ের জন্য তখনও প্রয়োজন ১৮৮ রান। খেলা বাকি আছে প্রায় ৩৩ ওভারের মত। এমন সময় ক্রিজে এলেন কুড়ি বছরের এক ‘অখ্যাত’ জ্যামাইকান তরুণ; নাম তাঁর রিকার্ডো পাওয়েল। যার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা মাত্র ৪ ম্যাচের!

পঞ্চম উইকেট জুটিতে পাওয়েল-চন্দরপল মিলে যোগ করলেন ৫৮ বলে ৬১ রান। যার ৪২-ই এসেছিল পাওয়েলের ব্যাট থেকে! দলীয় ১২৮ রানের মাথায় চন্দরপলের (২০) বিদায়ে আবারও ম্যাচে ফেরে ভারত। কারণ পাওয়েল ছাড়া স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে আর কেউ ছিল না। কিন্তু ভারতকে হারানোর জন্য সেদিন পাওয়েল একাই ছিলেন যথেষ্ট। ষষ্ঠ উইকেটে নেহামিয়া পেরিকে নিয়ে তিনি গড়লেন ১০৬ বলে ১১৮ রানের এক অবিশ্বাস্য পার্টনারশিপ। যেখানে পেরির অবদান ছিল মাত্র ৩৬!

সেদিন ব্যাট হাতে রীতিমতো তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিলেন পাওয়েল; কেবল ছক্কাই মেরেছিলেন ৮টা! যার বেশ কয়েকটা গিয়ে পড়েছিল স্টেডিয়ামের বাইরে! ৮ ছক্কা ও ৯ বাউন্ডারিতে সাজানো ৯৩ বলে ১২৪ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে পাওয়েল যখন আউট হলেন, উইন্ডিজ তখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে। ২৯ বলে দরকার ছিল মাত্র ৯ রান!

ডানহাতি পেসার হেন্ডারসন ব্রায়ানকে (৮ বলে ৬*) নিয়ে কেবল জয়ের বাকি আনুষ্ঠানিকতাটুকু সেরেছিলেন নেহামিয়া পেরি (৬৫ বলে ৩৮*)। ৩৩ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ভারতের পক্ষে সফলতম বোলার ছিলেন ডানহাতি পেসার দেবাশীষ মোহান্তি।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের নায়ক রিকার্ডো পাওয়েল সেদিন শুরুতে খেলছিলেন কিছুটা দেখেশুনে। পঞ্চাশ পেরিয়েছিলেন ৪৮ বলে, তবে সেঞ্চুরি ছুঁতে একদমই সময় নেননি তিনি। ভারতীয় বোলিং আক্রমণকে দুমড়ে-মুচড়ে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটা তুলে নেন মাত্র ৭২ বলে!

৯৩ বলে ১২৪! শুধুমাত্র রান-বলের পরিসংখ্যান দিয়ে এই ইনিংসের ইম্প্যাক্ট বোঝানো সম্ভব নয়। ফাইনালের মত হাই ভোল্টেজ ম্যাচে রান তাড়া করতে নেমে, দলের বিপর্যয়ের মুখে এরকম একা হাতে ম্যাচ জেতানো ইনিংস সবাই খেলতে পারে না।

উইজডেনের বিচারে যেটি ওয়ানডে ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ইনিংস। গত শতাব্দীর সেরা ১০০ ওয়ানডে ইনিংসের তালিকায় যার অবস্থান ১৬তম। উইজডেনের ভাষায়, ‘The manner in which he dominated the bowling was a sight to savour.’

একই বছর ভারতের বিপক্ষে কানাডার টরন্টোতে পাওয়েল উপহার দিয়েছিলেন ৭ ছক্কায় ৭৩ বলে ৭৬ রানের আরেকটা বিস্ফোরক ইনিংস। মাত্র ৫২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে দিগভ্রান্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একশো পার করিয়েছিল যে ইনিংসটি।

না বললেই নয় যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কনিষ্ঠতম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান (২০ বছর ২৬৬ দিন) হিসেবে রিকার্ডো পাওয়েলের রেকর্ডটা অক্ষত রয়েছে আজও। সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন শেমরন হেটমায়ার (২১ বছর ৭০ দিন)।

আক্রমণাত্মক ব্যাটিং ও ভয়ডরহীন মানসিকতার কারণে রিকার্ডো পাওয়েলকে একসময় মনে করা হত স্যার ভিভ রিচার্ডসের উত্তরসূরী। কিন্তু ক্লাস, সামর্থ্য কিংবা যোগ্যতায় ভিভের ধারেকাছেও যেতে পারেননি তিনি। তবে ভিভকে তিনি ছাড়িয়েছিলেন একটা জায়গায়, স্ট্রাইক রেটে! ওয়ানডেতে ১ সেঞ্চুরি ও ৮ ফিফটিতে ২০৮৫ রান করা রিকার্ডো পাওয়েলের স্ট্রাইক রেট ৯৬.৬৬! ১০০ ইনিংসে হাঁকিয়েছেন ৭৫ টি ছক্কা! এখানে জানিয়ে রাখা জরুরী যে, ওয়ানডেতে কমপক্ষে ২০০০ রান করা ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদের মধ্যে পাওয়েলের স্ট্রাইকরেটই সর্বোচ্চ!

ওয়ানডেতে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন মাত্র আটটি। এর মধ্যে তিনটিই আবার বাংলাদেশের বিপক্ষে। বোঝাই যাচ্ছে, বেশ ক’বারই বাংলাদেশের বোলারদের রাতের ঘুম হারাম করেছেন তিনি।

ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ‘ক্লিন হিটার’ রিকার্ডো পাওয়েল বিখ্যাত ছিলেন তাঁর ছোট্ট কিন্তু কার্যকরী সব ‘ক্যামিও’ ইনিংসের জন্য। ২০০৩ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাত্র ৩ রানে জেতা ম্যাচের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ধরা হয় পাওয়েলের এরকমই একটি ক্যামিও ইনিংসকে। পাওয়েল সেদিন ১৮ বলে ৪০ রান না করলে লারার দুর্দান্ত সেঞ্চুরিটা হয়ত বৃথাই যেত!

কিংবদন্তি মাইকেল হোল্ডিং যথার্থই বলেছেন, ‘প্রতিভার কী নিদারুণ অপচয়!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link