ওয়াসিম জাফর, অধরা গ্রেটনেস

বীরেন্দর শেবাগের মত আক্রমণাত্নক নন, তিনি শিখর ধাওয়ানের মত পাগলাটেও না কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের মত শৈল্পিক আঁচড়ও দেন না তিনি। তিনি যেন এক মৌন ঋষি, বাইশ গজে টিকে থাকাটাকেই যিনি করেছেন জীবনের ধ্যানজ্ঞান।

জমাট ডিফেন্স, বল ছেড়ে দেয়া, ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি হয়ে বোলারদের ক্লাস করে ফেলা- একজন প্রকৃত ক্ল্যাসিক্যাল টেস্ট ব্যাটারের সবগুলো গুণাবলিই ছিল তাঁর মাঝে। দেদারসে রান করেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে, কিন্তু সেই ফর্মটা টেনে আনতে পারেননি জাতীয় দলে। তাঁর চিরায়ত ব্যাটিংটাও ঠিক মন ভরাতে পারেননি দর্শকদের। তাঁরা বরং মজে ছিলেন ড্যাশিং বীরেন্দর শেবাগ, গৌতম গম্ভীর, শিখর ধাওয়ানে। অথচ কিছুটা সমর্থন তো তাঁরও প্রাপ্য ছিল। তিনি ওয়াসিম জাফর, শচীন হবার সম্ভাবনা থাকলেও যিনি বনে গেছেন কাম্বলী।

ভারতের মুম্বাইতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জাফরের। ছোটবেলাতেই স্কুল ক্রিকেটে জানান দেন নিজের প্রতিভার। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ৪০০ রানের ইনিংস খেলে হইচই ফেলে দেন চারিদিকে। সবাই তাঁকে ডাকতেন ভবিষ্যতের “মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন” নামে। চারিদিকের নামডাকের ফলে ঘরোয়া ক্রিকেটে সুযোগ পেতেও খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে তারকাবহুল মুম্বাই দলের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক ঘটে ওয়াসিম জাফরের। প্রথম ম্যাচে তেমন অবদান রাখতে না পারলেও সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেই ত্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকান। অপরাজিত ৩১৪ রানের ইনিংস খেলে জানান দেন বাইশ গজে রাজত্ব করতেই আগমণ তাঁর, হারিয়ে যেতে নয়। সেই ম্যাচে আরেক ওপেনার সুলক্ষণ কুলকার্নির সাথে গড়েছিলেন ৪৫৯ রানের উদ্বোধনী জুটি।

মুম্বাইয়ের পক্ষে রঞ্জি ট্রফিতে সেটাই ছিল প্রথম বারের মত ৪০০ ছাড়ানো উদ্বোধনী জুটি। সেই ম্যাচের পর থেকেই মুম্বাইয়ের ঘরোয়া ক্রিকেট পাড়ায় শচীন টেন্ডুলকার-বিনোদ কাম্বলিদের একই কাতারে উচ্চারিত হতে শুরু করে তাঁর নাম। সবাই ধরেই নেয় টেস্টে ভবিষ্যত ভারতের ব্যাটিং কান্ডারি হতে যাচ্ছেন তিনি।

বীরেন্দর শেবাগের মত আক্রমণাত্নক নন, তিনি শিখর ধাওয়ানের মত পাগলাটেও না কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের মত শৈল্পিক আঁচড়ও দেন না তিনি। তিনি যেন এক মৌন ঋষি, বাইশ গজে টিকে থাকাটাকেই যিনি করেছেন জীবনের ধ্যানজ্ঞান। উইকেটে টিকে থাকার অপরিসীম এক ধৈর্য্য নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি, ক্রিজে টিকে থাকতে পারতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। ঘরোয়া ক্রিকেটের অনবদ্য ব্যাটিং পারফরম্যান্সের পর জাতীয় দলের দরজা খুলে যেতেও সময় লাগেনি।

২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ভারতের হয়ে অভিষেক ওয়াসিম জাফরের। যদিও অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলকদের সাথে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি সেবার, চার ইনিংস খেলে সংগ্রহ করেন সাকুল্যে ৪৬ রান। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি করলেও জাতীয় দলে টিকে থাকার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না, ফলশ্রুতিতে বাদ পড়েন দল থেকে। 

ভারতীয় জাতীয় দলে পুনরায় ফিরে আসা তিন বছর পরে। ততদিনে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে নিজেকে আরেকটু বাজিয়ে নিয়েছেন ওয়াসিম, হয়েছেন আরো ঋদ্ধ, পরিণত। কানপুরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা। পরের বছরই অ্যান্টিগাতে ক্যারিবীয় পেসারদের সামলে দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেন ২১২ রানের মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস।

ওই ইনিংসের পরই মূলত জাতীয় দলে জায়গাটা পাকাপোক্ত হয় তাঁর। তবে তাঁর জীবনে সবচেয়ে ভালো সময়টা কাটিয়েছেন ২০০৭ সালে। সেই বছরই দেখা পান নিজের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় দ্বি-শতকের, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেন ২০২ রানের চমৎকার এক ইনিংস। মাঝে সাদা বলের ক্রিকেটেও অভিষেক ঘটে তাঁর, কিন্তু সেই ফরম্যাটে আলো ছড়াতে পারেননি।  

এরপরই জাতীয় দলে ফর্মের পতনের শুরু। আসলে ঘরোয়া ক্রিকেটের রানের ধারাটা কখনোই জাতীয় দলে টেনে নিতে পারেননি। জাতীয় দলে যেখানে ৩১ টেস্ট খেলে মাত্র ৩৪ গড়ে করেছেন দুই হাজারেরও কম রান। সেখানে ঘরোয়া ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের সমস্ত রেকর্ড গড়াগড়ি খেয়েছে তাঁর ব্যাটিংয়ের সামনে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৫৭ শতক আর ৯১ অর্ধ-শতকের সাহায্যে ৫০.৬৭ গড়ে করেছেন ১৯ হাজারেরও বেশি রান। 

অমল মুজুমদারকে ছাপিয়ে তিনিই রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। ক্যারিয়ারের শেষবেলাতেও এসেছিলেন সমান সাবলীল, রঞ্জি ট্রফিতে দল পাল্টে বিদর্ভে আসলেও কমেনি রানের ফল্গুধারা। ছোটদল বিদর্ভকে শিরোপা জিতিয়েছেন ৪১ বছর বয়সে এসে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলা জাফর, ঘরোয়া ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন ২০২০ সালে। এছাড়া আইপিএলের প্রথম আসরে রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে খেলেন তিনি।

তবে বাইশ গজ ছাড়লেও ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। শুরুতে উত্তরাখন্ডের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হলেও অপ্রত্যাশিত এক ঘটনায় সরে দাঁড়ান সেই দায়িত্ব থেকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুমে মৌলভি নিয়ে আসার। ফলে কোচের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান তিনি।

এরপর বাংলাদেশ জাতীয় দল এবং হাইপারফরম্যান্স স্কোয়াডের ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে কাজ করছেন বাংলাদেশ অনূর্ধব-১৯ জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে। নিজের শচীন হতে না পারলেও হয়তো স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যত শচীনের কাণ্ডারি হয়ে ওঠার।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...