রিচার্লিসন, দারিদ্রের শূন্যতা থেকে সাফল্যের শিখরে

জৌলুসময় ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসেছে কাতারে। সেখানে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচে জোড়া গোল করে ব্রাজিলকে জিতিয়ে দিলেন একজন স্ট্রাইকার, নাম রিচার্লিসন। জার্সি নম্বর নাইন। এই আসরের চোখ ধাঁধানো ‘বাইসাইকেল কিক’ করে মুগ্ধ করলেন বিশ্ববাসীকে। একেবারে চক্ষুশীতল করা একটি গোল, যা ফুটবল বিশ্বে রিচার্লিসন নামটিকে নতুন করে চিনিয়েছে। এটিকে এই বিশ্বকাপের সেরা গোল বলেও অভিহিত করছেন অনেকে।

এমনিতেও এই মৌসুমে ব্রাজিলের হয়ে সাত ম্যাচে নয়টি গোল করেছেন ২৫ বছর বয়সী এই তারকা। গেল ম্যাচের পর ব্রাজিলের মুগ্ধতাই বনে গেলেন রীতিমত। ব্রাজিলের নয় নম্বর জার্সির গল্পটাই বদলে দিলেন যেন। ম্যাচ শেষে রিচার্লিসন বললেন, ‘প্রফেসর তিতে বলেছেন আমার গা থেকে গোলের ঘ্রাণ বেরুচ্ছে এবং আসলেও তাই হচ্ছে।’

অথচ এই তারকার তারকা হওয়ার গল্পটা বড্ড অন্যরকম ছিল। সোনার চামচ মুখে জন্ম হয়নি তাঁর। রিচার্লিসনের বাবা একজন রাজমিস্ত্রি এবং মা আইস ক্যান্ডি বিক্রি করতেন। তিনি বেড়ে উঠেছেন নোভা ভেনেসিয়া এলাকায়, যেটি আবার মাদক এবং পাচারের জন্য বিখ্যাত ছিল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় রিচার্লিসনদের তাই প্রায়ই অনাহারে দিন যেত।

পরিবারের বড় হিসেবে তাই তাঁকেও কিছু দায়িত্ব পালন করতে হত। রিচার্লিসনের বন্ধুরা যখন মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে এবং অগাধ টাকার মালিক হয়, রিচার্লিসন তখন অভাব সত্ত্বেও নিজেকে সংযত করতেন। তখন তিনি চকলেট, আইসক্রিম বিক্রি এবং গাড়ি ধোয়ার কাজ করতেন।

তাঁর বয়স যখন চৌদ্দ তখন একবার এক মাদক চোরাকারবারী মাদক চুরির অভিযোগে রিচার্লিসনের মাথায় বন্দুক ধরেছিল। রিচার্লিসনের মতে, সেই দিনই তাঁর জীবনের শেষ দিন হতে পারত! পরে তাঁকে হুমকি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অথচ তিনি এসবে জড়িতই ছিলেন না।

রিচার্লিসনও হয়ত পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের মত মাদকের অন্ধকার জগতে হারিয়ে যেতে পারতেন। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল তাঁর বাবার থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া একটি ফুটবল। ফুটবলটি তাঁকে বাঁচিয়েছিল। কারণ তিনি তখন ফুটবল খেলায় জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর বাবা চাইতেন রিচার্লিসন যেন বখে না গিয়ে একজন ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন লালন করেন। সেখানে রাস্তায় তিনি তাঁর বন্ধুদের সাথে ফুটবলে বুঁদ হয়ে থাকতেন।

স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী রিচার্লিসনের ফুটবল দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি তাঁকে একজোড়া বুট উপহার দিয়েছিলেন এবং তাঁকে আমেরিকা মিনেইরো নামক ক্লাবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। এরপর তাঁর রিচার্লিসনকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

২০১৬–১৭ মৌসুমে তিনি ফ্লুমিনেন্সেতে যোগদান করেছেন। ফ্লুমিনেন্সেতে মাত্র ১ মৌসুম অতিবাহিত করার পর প্রায় ১১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইংরেজ ক্লাব ওয়াটফোর্ডের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তারপর ২০১৮–১৯ মৌসুমে, তিনি প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ওয়াটফোর্ড হতে এভার্টনে যোগদান করেছেন। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের হয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিষেক ঘটে তাঁর।

মাঠের বাইরেও রিচার্লিসন বর্ণবাদ থেকে শুরু করে পান্তানালে আগুন, পুলিশ হত্যা এবং এমনকি বিদ্যুতের অভাবের বিষয়ে সোচ্চার হওয়ায় খবরে এসেছেন বারবার। সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর দু:খ-কষ্ট বরাবরই তাঁকে ছুঁয়েছে। ২০২০ সালের শেষের দিকে উরুগুয়ের বিপক্ষে একটি গোল করার পরে, রিচার্লিসন ব্রাজিলের একটি অঞ্চলে যথাযথ বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবের বিষয়টি সবার সামনে নিয়ে আসেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘দু:খজনকভাবে আমার লোকেরা আজ আমার গোলটি দেখতে পাবে না, কারণ তাঁদের ওখানে দুই সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎ নেই।’

অর্থাৎ নিজের পাবলিক ইমেজকে কাজে লাগিয়ে তিনি সমাজের জন্য বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। সম্ভবত সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণী থেকে উঠে এসেছেন বলেই তাঁদের জীবনটা বেশি অনুভব করে থাকেন। নি:সন্দেহে মাঠের এই নায়ক, মাঠের বাইরেও বাস্তব জীবনে নায়কের ভূমিকায় থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link