সদ্য কলেজ পেরোনো অনিক এক গাঢ় নিকষ কালো রাতের আঁধারে তার পরম আশ্রয় বাবাকে চিরতরে হারিয়ে ফেললো। জীবনের ছাদ হারিয়ে অনিক সমাজ জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিজেকে একপ্রকার ঘরবন্দি করে ফেললো। শোক কাটিয়ে বাড়ির বাকিরা অনিককে নিয়ে চিন্তান্বিত হয়ে পড়লো। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ক্লাস, বন্ধু – বান্ধব, প্রিয় ফুটবল খেলা, প্রিয়তম সিআর সেভেন – সব ছেড়েছুড়ে অনিক নীলচে ডিমলাইটের বিষাদময় আলোয় মাখা ঘরটাকেই তার ভাঙা হৃদয়ের পরম নীড় বানিয়ে নিল।
একদিন নীলচে আলোয় ঘরবন্দি অনিকের চোখ আটকে গেলে ঘরের পূর্বদিকের দেওয়ালে আটকানো পোস্টারটার দিকে। অনিক পোস্টারটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো আর তার মাথায় ভাবনারা এসে ভিড় জমাতে লাগলো – ছবির লোকটাও তো বাবাকে হারিয়েছিল। কিন্তু থেমে থাকেনি। বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার হয়ে হারিয়ে যাওয়া বাবার স্বপ্নকে হারিয়ে যেতে দেয়নি।
অনিক ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোয়াল শক্ত করে চোখের জল মুছতে মুছতে স্থির করলো ও আগামীকাল থেকে আবার ইউনিভার্সিটিতে যাবে, পোস্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে গবেষণা করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে এবং মনে মনে একটাই শব্দ বিড়বিড় করতে লাগলো – রাইজ!
কলকাতার বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা বরুণ প্রতিদিনই লোকাল ট্রেনে চেপে যখন স্থানীয় স্টেশনে নামে তখন ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা সাতটা ছুঁইছুঁই। ইদানিং, স্টেশনের পাশের রাস্তা দিয়ে বাইক নিয়ে ফেরার সময় বরুণ দেখে রেললাইনের পাশের বস্তির কয়েকটা কিশোর স্ট্রিটল্যাম্পবিহীন গলিপথের ধারে বসে নিষিদ্ধ নেশায় ব্যস্ত। শিক্ষক পরিচয়ের পাশাপাশি সমাজকর্মী হিসাবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত বরুণ দৃশ্যটা দেখে প্রাথমিকভাবে হতাশ হয়ে পড়লেও তৎক্ষনাৎ স্থির করে ছেলেগুলোকে নেশার জাল কেটে বার করে আনতে হবেই।
একদিন বরুণ প্ল্যানমাফিক বাইকে চেপে স্টেশনে গেলো না। ফেরার সময় অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিপথটা ধরে পায়ে হেঁটে ফিরতে ফিরতে নেশাচ্ছন্ন ছেলেগুলোর আলোচনা থেকে শুনতে পেলো যে ছেলেগুলো ফুটবল খেলা নিয়ে আলোচনা করছে। ছেলেগুলোর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু জুড়ে যে স্বপ্নের সওদাগরটি তিনি তো বরুণেরও অনুপ্রেরণা।
পরদিন বরুণ আবারও প্ল্যানমাফিক হেঁটে ফেরার সময় ছেলেগুলোকে যখন পাশ কাটাচ্ছে তখন তার ফোনের ইউটিউবে ছেলেগুলোর স্বপ্নের নায়কের একটি খেলার ভিডিও উচ্চগ্রামে চালিয়ে দিল। এ যে কি এমন নেশার টান কে জানে ! ছেলেগুলো তাদের প্রিয় নায়কের নামটা শোনামাত্রই নেশার সরঞ্জাম ফেলে বরুণের মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে পছন্দের ফুটবলারটিকে বল পায়ে দেখার জন্য বরুণকে ছেঁকে ধরলো।
বরুণ মনে মনে ভাবলো এই তো এদের নেশামুক্তির ওষুধ পাওয়া গেছে। বরুণ বলে উঠলো – রোনালদো! ছেলেগুলোও সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো – রোনালদো। ছেলেগুলোর চিৎকার শীতের সন্ধ্যের মফস্বলের নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যাওয়ার আগেই বরুণ বিড়বিড় করে বলে উঠলো – রোর!
অবিচারের ৭০০ দিন! – প্ল্যাকার্ডটি হাতে রিলে অনশনরত বছর ছাব্বিশের বিপ্লব আজ স্মৃতিমেদুরতায় ভুগছে। ওর সেই শুরুর দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। বছর দুয়েক আগে যখন রাজ্যজুড়ে স্কুল শিক্ষক নিয়োগে বেনিয়ম ধরা পড়লো তখনও কেউই প্রতিবাদের, ন্যায্য দাবি জানানোর সাহস পায়নি। বিপ্লবেরও অতটা সাহস জোটেনি। ন্যায্য চাকরি চুরির শিকার বিপ্লব জেলা থেকে রাজ্য … স্কুল শিক্ষা দপ্তরের বিভিন্ন জায়গায় ঢুঁ মেরে অভিযোগ জানাতে গিয়ে গলাধাক্কা, হুমকির মুখোমুখি হয়ে একসময় হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ভেবেছিল ন্যায্য চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের কাছে পরাজয় বরণ করে নেওয়াটাই হয়তো ভবিতব্য।
তবে, বিপ্লবের এই মানসিক যন্ত্রণার দিনগুলোতে তেমন কাউকে পাশে না পেলেও পাশে পেয়েছে তার প্রিয় খেলা ফুটবলকে। যখনই অন্যায়ের সাথে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়া মন যখন লড়াই থেকে পালাতে চেয়েছে তখনই নিজেকে ফুটবলে বা আরো বিশেষ করে নিজের অনুপ্রেরণার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে।
বছর দুয়েক আগের তেমনই এক চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রাত। আগের লেগে বিপ্লবের প্রিয় নায়কের ক্লাব জুভেন্টাস আতলেতিকো মাদ্রিদের কাছে প্রথম লেগে গোহারান হেরে দ্বিতীয় লেগে নেমেছে। ফুটবল বিশ্বজুড়ে কেউই আর টুর্নামেন্টে জুভেন্টাসের অগ্রগমন দেখতে পাচ্ছেন না। এমনই এক রাতে বিপ্লবের স্বপ্নের নায়ক সমগ্র ফুটবল বিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণিত করে অবিশ্বাস্য হ্যাটট্রিক করে পাশা পাল্টে দিলেন।
রোমহর্ষক রাতের রোমাঞ্চে রোমাঞ্চিত বিপ্লব সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নিল যে আর হতাশ হয়ে বসে থাকলে হবে না, জবাব দিতে হবে, ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিতে হবে। আপন খেয়ালই বিপ্লব বিড়বিড় করে উঠলো – রিভোল্ট! ক্যারিয়ারের উপান্তে পৌঁছানো তাদের স্বপ্নের নায়কের কাছে অনিক, বরুণ, বিপ্লবরা একসুরে, একজোটে, একসাথে দাবি জানিয়ে চলেছেন – রাইজ – রোর – রিভোল্ট!