গুলবেদিন নায়েব তাঁর ওভারের চতুর্থ বলটি করলেন। লো ফুল টস ডেলিভারিটা থেকে সেট আফিফ চাইলেই একটা রান করে ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু আফিফ সলিড ডিফেন্স করলেন। বোধহয় স্মরণীয় একটা শেষ চাচ্ছিলেন তিনি। পরের শর্ট বলটা সজোরে পুল করে বাউন্ডারির বাইরে পাঠালেন। দলকে জিতিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকালেন। অন্য প্রান্তে থাকা আরেক নায়ক মিরাজ তখন যেন হাওয়ায় ভেসে যেতে চাইছেন।
অথচ ঘন্টা কয়েক আগেও দৃশ্যপট ছিল একদম উল্টো। লিটন দাস, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম কিংবা অভিষিক্ত ইয়াসির আলী রাব্বি টপ অর্ডারের চারজনই ফিরলেন আফগান পেসার ফজল হক ফারুকীর বলে। ১৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন দিশেহারা বাংলাদেশ। বড় আশা হয়ে থাকে সাকিব আল হাসানও ফিরে গেলেন দলীয় ২৮ রানের মাথায়।
বাংলাদেশ তখন জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছে। মাত্র ৮ রান করে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও বিদায় নিয়েছেন। চট্টগ্রামের দর্শকদের মাথায় হাত। কেউ কেউ মাঠ থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছেন, কেউ আবার থেকে যাচ্ছেন সম্মানজনক একটা স্কোর দেখার আশায়। কেননা আরেকবার একশো রানের নিচে অল আউট হওয়ার শঙ্কা তখন জেঁকে বসেছে।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেই লজ্জা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হিসেবে তখন বাইশ গজে শেষ স্বীকৃত জুটি আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ। এই দুই ব্যাটসম্যান বোধহয় বাকিদের মত করে ভাবেননি। তাঁরা বোধহয় সেই সময়ও বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যে এখান থেকেও ফিরে আসা যায়। পুরো একটা ক্রিকেটা দুনিয়াকে চমকে দেয়া যায়।
অথচ দুজনই খুব একটা ভালো অবস্থানে ছিলেন না। পুরো বিপিএলে ব্যাট হাতে সেভাবে রানের দেখা পাননি আফিফ হোসেন। ব্যাট হাতে বেশ ভুগছিলেন এই ব্যাটসম্যান। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেই নিজের সেরাটা নিঙরে দিলেন।
বিপিএলে আফিফের সাথে একই দলে খেলেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। এই অলরাউন্ডার অবশ্য ব্যাট, বলে ছন্দেই ছিলেন। তবে টুর্নামেন্টের মাঝপথে অধিনায়কত্ব নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। তবে সেসব কিছুই এই অলরাউন্ডার পিছনে ফেলে এসেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবারো দেখা মিললো ব্যাটসম্যান মিরাজের।
আর আট নাম্বারে নেমে রান করাটাই যেন এই ব্যাটসম্যানের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গতবছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই চট্টগ্রামেই টেস্ট সেঞ্চুরি করেছিলেন ৮ নম্বরে নেমে। আজও আট নাম্বারে নেমে খেললেন ৮১ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস। তিনি যে সত্যিকারের অলরাউন্ডার সেটা আরেকবার প্রমাণ করলেন।
ওদিকে আফিফের ব্যাটিং নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তবে বাংলাদেশ এই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে ব্যবহার করছে সাত নাম্বারে। সেটা নিয়ে সমালোচনার জায়গা আছে। তবে আফিফ আজ সেসব কিছু মনেও আনতে দেননি। দল এত বড় চাপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার পরে ব্যাটিং করতে নেমেছেন। তবুও প্রথম বল থেকেই আফিফ ছিলেন সাবলীল। অন্য ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। বাইশ গজের চারদিকে চোখ জুড়ানো সব শট খেলেছেন।
চার মেরে দলকে জয় এনে দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ৯৩ রানে। মিরাজ আর আফিফ যেন ভয়ংকর হয়ে উঠা আফগান বোলারদের খেলনা বানিয়ে ফেললেন। সপ্তম উইকেটে দুজনে মিলে করলেন ১৭৪ রানের অপরাজিত জুটি। দলকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছেড়েছেন এই দুজন।
সপ্তম উইকেটে ওয়ানডে ফরম্যাটের সবচেয়ে বড় জুটি গড়ার রেকর্ড আছে ইংল্যান্ডের জস বাটলার ও আদিল রশিদের। আর এই দুজনের পরেই ১৭৪ রান নিয়ে থাকবেন আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে এই দুই ব্যাটসম্যান যে চাপ নিয়ে ব্যাটিং করেছেন সেটা আর কেউ করতে পারেনি ক্রিকেট ইতিহাসে। দলীয় ৫০ রানের মাথায় ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর সপ্তম উইকেটে এটাই ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ জুটি।
তবে এসব পরিসংখ্যান নয়, এই জুটির আসল সৌন্দর্য হলো নজর কেড়ে নেওয়া, সাহস তৈরি করা। বাংলাদেশের সেরা জুটি ছিলো সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেই জুটি। রিয়াদ-সাকিব তখন পরিণত তারকা। তাদের ওপর প্রত্যাশা ছিলো। কিন্তু আফিফ-মিরাজ কেবল উঠে আসছেন। তাদের নিয়ে আছে স্বপ্ন।
আজ মিরাজ-আফিফ বলে দিলেন, তারা স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন। তারা তারুন্যের হুঙ্কার দিতে জানেন।