সবাই বুড়ো হয়ে গেছে তখন। বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের মধ্যে একটা চ্যারিটি ম্যাচ হচ্ছে যেখানে দুটো টিমেরই অলস্টার প্লেয়াররা খেলবে। তা তিনি নামলেন, সেই পুরোনো স্টাইলে হেয়ারব্যান্ড মাথায় পরে। নামলেন এবং টাচ খেললেন।
এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করার, সেটা হল তিনি এবং আরেক স্বদেশীয় – দু’জনেই নেমেছেন ১০ নম্বর জার্সি গায়ে। বার্সেলোনা লিজেন্ডদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ যারা, তাদের সাথে একই সিটে বসা এই নো-হেটার ভদ্রলোক একটা পাস বাড়ালেন ঐ স্বদেশীয় রিভালদোকে। মুহূর্তে করতালিতে ভেসে গেল গোটা অ্যারিনা।
মুখে সেই হাসি, ডান পায়ের মুভমেন্ট দেখে বোঝা যাচ্ছে এখনও সূর্য পুরোপুরি অস্ত যায়নি। শেষ কিরণের কিছু অন্তত বাকি। এককালে যা ছিল দাবদাহ! স্টেপওভার, ছোট্ট টাচে কোমরটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ছিটকে দেওয়া মার্ক করা ডিফেন্ডারকে, চকিতে টার্ন – যেন শেষ জীবনে অ্যাসাইলামে বসে ভিনসেন্ট আঁকছেন তাঁর শেষ ছবি, শেষ করছেন অপূর্ণ কাজ।
রোনালদিনহো গাউচো। মেশিনে ভরা ফুটবল পৃথিবীতে জন্মানো এক বাঁশিওয়ালা।
গ্রেমিওতে শুরুর সময়ই চোখে পড়েছিল তার ট্যালেন্ট। ব্রাজিল ফুটবলের দেশ, সেখানে শোনা যায় পথে ঘাটে কিছু পয়সার বিনিময়ে ছোট ছেলেদের দল ফুটবলের স্কিল প্রদর্শন করে। এমন পরিবেশ থেকে উঠে আসা অনেক ট্যালেন্টই যত্নআত্তি ঠিকঠাক না হওয়ার দরুণ হারিয়ে যায়, কিন্তু যাকে হরি রাখে তাকে মারে কে!
গ্রেমিওতে থাকাকালীন একটা ম্যাচে দুঙ্গার বিরুদ্ধে খেলতে হয়। সেই দুঙ্গা, রাই ক্যাপ্টেন্সি ছাড়ার পর বিশ্বকাপ ছুঁতে পারা ব্রাজিল অধিনায়ক। ড্রিবলে ড্রিবলে হল্লাক ক’রে মাঠ ছেড়েছিল গাউচো, হতবাক দুঙ্গা দ্বিতীয়বার ভাবেনি রোনালদিনহোকে ’৯৭-এর কোপায় দেশের জার্সি গায়ে তোলাতে।
এমনই এক ভবঘুরে, উদাসী বাউল যেন। কোনও কিছুতে কোনও পরোয়া নেই। বার্সেলোনার যে সময়ে রোনালদিনহো খেলতে এসেছিল তখন কাতালুনিয়ানদের জন্য বড় অস্থির সময়। লিগ নেই, কাপ নেই – চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল তরতর ক’রে এগোচ্ছে, এমন সময় ক্লাবে পা রোনালদিনহোর। আর এসেই পেলেন লা লিগা, জেতালেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। কত কত মোমেন্ট দিয়ে গেছে লোকটা – শুধু বার্সেলোনাতেই। মেসির প্রথম গোলের পর কাঁধে তুলে নিয়ে কান পর্যন্ত হাসি হাসা তো জীবনে কেউ ভুলবে না!
ব্রাজিল সমর্থকরাও তেমনই ভুলবে না একটা দিনের গল্প। ২১শে জুন, ২০০২। মাইকেল আওয়েনের গোলে লিড করার পর যদিও রোনালদিনহোর পাস থেকেই রিভালদো সমতা ফেরায়, তবু মোমেন্ট ক্রিয়েশনের কিছু বাকি ছিল। সেকেন্ড হাফের ৫০ মিনিটের দিকে ডানদিকে একটা ফ্রি কিক পায় ব্রাজিল। মারতে যান জীবনে প্রথম বিশ্বকাপ খেলা গাউচো। ডেভিড সিম্যান জীবনে যতবার গোলকিপার হিসেবে বোকা বনেছেন, রোনাল্ডিনহোর ফ্রি কিক সে তালিকায় হেসেখেলে উপরের দিকে থাকবেই। ঐ ডান পা-কে চুমু খেয়ে বলতে ইচ্ছে করে, কী অসাধারণ! নাজুক।
রোনালদিনহোকে নিয়ে লেখার মধ্যে, আলোচনা বা দেখার মধ্যে একটা আকুলতা লুকিয়ে থাকে। এই লোকটাকে খেলতে দেখেছি লাইভ – এটা জীবনের পাওয়া। রোনালদো, রিভালদো, রবার্তো কার্লোস, কাফু, তাফারেল, দুঙ্গা – ভরা সোনার সংসারের মাঝে রোনাল্ডিনহো এসেছিলেন তারাভরা আকাশের মাঝে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে।
ব্রাজিলের মূল্যবান সম্পদগুলোর মাঝে এক কাচ কাটা হীরে। যা সর্বদা দ্যুতিমান – জীবনে সবকিছু পেয়েছেন। বিশ্বকাপ, লা লিগা, সিরি এ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ইন্ডিভিজুয়াল ট্রফি হিসেবে ব্যাল ডি অর। শেষ লগ্নে ইনজুরিপ্রবণ হয়ে যাওয়ায় ক্যারিয়ার বেশি দূর এগোলো না, ফ্ল্যামেঙ্গোতে যোগ দিলেন। খেলা অনেক পড়ে গিয়েছিল, চোট-আঘাতের সংখ্যা বেড়েছিল, ফুটবল ছাড়তেই হতো কখনো না কখনো। কিন্তু তাও!
থাকার মধ্যে রয়ে গিয়েছিল ঐ ভুবনমোহিনী ডান পা’টা। উঠতি তরুণ সুপারস্টার নেইমার সাক্ষী সে ঘটনার। ৫-৪ ম্যাচের গল্প সবাই জানে, সে গল্প আমাদের জানাচ্ছে যে ডান পায়ের মাধুর্য রোনাল্ডিনহোর থেকে কখনোই ছিনিয়ে নেওয়া যায়নি, আজ ৪২-এ পদার্পণ করার পরেও যদি মাঠে নামানো যায়, তবে এমনই কিছু ঝলক না দেখিয়ে লোকটা অ্যারিনা ছাড়বে না।
গাম কা খাজানা তেরা ভি হ্যায়, মেরা ভি। রোনালদিনহো ফুটবল তারাদের মাঝে বসত গড়া চিরকালীন বাঁশিওয়ালা। নওজওয়ানদের প্রেমিক, অশীতিপরদের বিস্ময়। খোদা ক্যায়া জানে ইসমে দাম কিতনা। সনাতন ভালবাসার প্রতীক হয়ে রোনালদিনহো ভেসে বেড়াক আরও শত শত বছর।