কত এলোমেলো পথ হেঁটেছি দুজন

খুব ছোট বয়সেই দুজনে গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন ছিল। একজন জন ম্যাকেনরোর আর একজন মজিদ বাসকরের। সেখান থেকে মুম্বাইকরের জীবন বদলে দিলো এক রবিবাসরীয় বিকেল এবং দেবানন্দ অভিনীত গাইড আর একজনের হঠাৎ মনে হলো যে সেও দাদার মতো ক্রিকেটটা খেলতে পারে। অত:পর একজনের ঠিকানা মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্ক এবং আর একজন কলকাতা ময়দানের দুখিরাম কোচিং সেন্টার। ঠিকই ধরেছেন, এই দুজন হলেন সৌরভের ‘ছোটবাবু’ আর শচীনের ‘দাদি’।

কৈলাশ ঘাটানির অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে বিলেত সফর এবং ইন্দরের ক্যাম্প থেকে পরিচয় দুজনের এবং বন্ধুত্বের শুরু আর সেই বন্ধুত্ব এতটাই গভীর সেই সময় থেকে যে কৈশোরের ছোটখাটো খুনসুটি বা দুষ্টুমিও সেই বন্ধুত্বে নেতিবাচক রেখাপাত করে না।

কিন্তু বিধি বাম। শুরুটা একদম মহাভারতের অর্জুন আর কর্ণের আদলে। দুজনেই ভারতমাতার সন্তান। প্রায় সমান প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও একজন শুরু থেকে পেয়েছেন লাল গোলাপ বিছানো পথ আর তাতে ভর করে তরতর করে এগিয়ে গেছেন আর একজনের জন্য অপেক্ষা করছিল লবি সর্বস্ব ভারতীয় ক্রিকেটের কণ্টকময় অঞ্চল। মুম্বই ক্রিকেটের আভিজাত্যময় পরিবেশ ও গরিমা দিয়ে শচীন তার প্রতিভাকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছিল কিন্তু সৌরভের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠে এসেছিল কি তোমার (ক্রিকেট) বংশ পরিচয়? যোগ্যতা কি?

কোন অধিকারে এখানে লড়তে (খেলতে) এসেছ? ঠিক যে প্রশ্ন প্রকৃত বীর হওয়া সত্ত্বেও শুনতে হয়েছিল ‘অধিরথ পুত্র’ কর্নকে। আর তাই পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং শ্রদ্ধা বজায় রেখেই দুজনে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করলেন রঞ্জি, দিলীপ এমন কি, পি সেন ট্ৰফির ফাইনালও। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ পারেননি যুদ্ধের আগে কর্নকে তার আসল পরিচয় দিয়েও পাণ্ডব শিবিরে ফেরাতে আর পারলে তার পরিণতি কি হতো তার উত্তর মহাকালের কাছেই আছে।

কিন্তু, এই যুগে সেই অসাধ্য সাধন ২৩ এপ্রিল ১৯৯৬-তে দিল্লীর তাজ প্যালেস হোটেলে করে দেখালেন সম্বরণ ব্যানার্জি। ক্রিকেটীয় কুলশীলহীন বাংলার ঘরে জন্ম নেওয়া সৌরভকে পৌঁছে দিলেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ দুই প্রতিভা একই দলের সদস্য হলেন। পরবর্তী ১২-১৩ বছর ক্রিকেট দুনিয়া দেখলো কর্ন আর অর্জুন একসঙ্গে যুদ্ধ করলে সেটা কি রূপ নেয়।

৯৬’এর এর লর্ডসে আভাস মিললেও কয়েকদিন বাদে নটিংহ্যামর মেঘলা আকাশের নিচে ক্রিকেট বিশ্ব প্রথমবারের জন্য দেখলো দুজনের পরাক্রম, ওই পার্টনারশিপটাতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী এক যুগের রোডম্যাপ। এরপর শুরু হল প্রতিপত্তি বিস্তার। একজন ওয়ার্নের স্বপ্নে দেখা দেন তো আর একজন রাওলপিন্ডি এক্সপ্রেস চেন টেনে থামিয়ে দেন!

একি স্বপ্ন নাকি সত্যি? এই বিস্ময়, এই প্রশ্নটাই বার বার উঠে এসেছে যখনই দেখেছি এই দুজনকে একসঙ্গে ব্যাট করতে। মাঠের বাইরের রসায়নের সঙ্গে মাঠের ভেতরের প্রতিভার যে সংমিশ্রণ তৈরি হতো তা যেন অতুলনীয়। একটুকরো উইলো নয় দুজনে স্ব-মহিমায় যখন ব্যাট করতো মনে হতো যেন তুলি হাতে সবুজ গালিচাকে ক্যানভাস বানিয়ে লিওনার্দো এবং পিকাসো তাদের সৃষ্টির খেলায় মেতে উঠেছেন, কখনো মনে হতো সর্বোচ্চ পর্যায়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুর বেজে চলেছে। সেই সঙ্গীতে অবগাহন করেছে নটিংহ্যাম থেকে জোহানেসবার্গ, ইডেন থেকে মেলবোর্ন। দুজনের ব্যাটসম্যানশিপের চূড়ান্ত নিদর্শন ক্রিকেট দুনিয়াকে সম্মোহিত করে রেখেছিল দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়, আজও সম্মোহিত হয়ে আছে সম্পূর্ণ একটা প্রজন্ম।

এই চূড়ান্ত সাফল্য, এক নম্বর হওয়ার সুস্থ প্রতিযোগিতা কখনো তাদের ভেতরের বন্ধুত্বে বাঁধা জয়ে দাঁড়ায়নি। শচীন অধিনায়ক থাকার সময় সৌরভকে বাদ দিয়েছেন প্রথম ১১ থেকে বা অধিনায়ক সৌরভ কখনো ব্যাটিং অর্ডারে শচীনকে পিছিয়ে দিয়েছেন কিন্তু পেশাদারিত্বের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্কের এমন এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তারা বজায় রেখেছিলেন যে চরম ছিদ্রান্বেষী সাংবাদিকও সেখান থেকে মুচমুচে গল্প তৈরি করতে পারেনি।

সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেও কিভাবে নিজেদের ভেতরের সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে হয় সমস্ত ঈর্ষা এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতার ঊর্ধ্বে উঠে, তার চিরন্তন প্রতীক হয়ে থাকবেন ভারতীয় ক্রিকেটের এই দুই জীবন্ত কিংবদন্তি যারা কঠিন সময়ে বন্ধুর (অধিনায়কের) ডাকে সবসময় সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য সৈনিক হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছে, ভারতীয় ক্রিকেটকে ঘিরে এমন এক চক্রবুহ্য বানিয়েছেন যে তাদের সাম্রাজ্যকালের সময় ক্রিকেট বুকিদের লোলুপ কিন্তু আগ্রাসী দৃষ্টি সেই বুহ্য ভেদ করতে পারেনি। ভারতীয় ক্রিকেট থাকতে পেরেছে সম্পূর্ণ নিষ্কল-ঙ্কিত।

সেই কারণে হাজার হাজার রান নয়, কয়েকশো উইকেট বা কয়েকটা ট্রফি নয়, ক্রিকেটপ্রেমীরা চিরকাল এই দুই বন্ধুকে মনে রাখবে অর্থ, লোভ, ক্ষমতা, লালসার অতল সাগরে তলিয়ে যেতে বসা ভারতীয় ক্রিকেটকে পুনর্জন্ম দেওয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দুই কারিগর হিসেবে, যাদের যুগপৎ লড়াই একটা সম্পূর্ণ জাতিকে আবার ভাবতে শিখিয়েছিল যে ক্রিকেটটা সত্যি ভদ্রলোকের খেলা। আর তাই আজও আমরা তাদের প্রেমে গভীরভাবে আচ্ছন্ন। অনুগ্রহ করে কেউ বিরক্ত করবেন না। আর একটু সময়; নাকি ভুল বললাম, জীবনের বাকি সময়টাও একই ভাবে এদের প্রেমে আচ্ছন্ন থাকতে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link