ওরা চারজন, বিস্ময়ের চার রত্ন

উদ্দেশ্য প্রথমেই পরিষ্কার করে দেই – শচীন টেন্ডুলকার নামের ব্যাটসম্যানের ক্রিকেট ইতিহাসে স্থান নির্ধারণ করা। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে শচীনের চব্বিশ বছরের ক্যারিয়রের সেরা দিকগুলো উঠিয়ে আনার চেষ্টা করব এই সিরিজে।

সেই সঙ্গে লক্ষ্য থাকবে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের পায়ের ঠিক কোন জায়গাটি মাটি দিয়ে গড়া সেটা খুঁজে বের করা। কী বললেন? তাহলে নিরপক্ষতা থাকবে না? হয়ত তাই। তাছাড়া এই ধরনের আলোচনায় সত্যিকারের নিরপেক্ষতা থাকে কিনা আমার জানা নেই। সবাই কিছু না কিছু প্রিজুডিস নিয়েই আলোচনায় নামেন। তাছাড়া কাউন্টার পয়েন্ট তুলে আনার জন্য আপনারা তো আছেনই।

আলোচনা শুরু করছি গত পঞ্চাশ বছরের চারটি সবচেয়ে আলোচিত ব্যাটসম্যানদের নিয়ে। সুনীল গাভাস্কার, ভিভ রিচার্ডস, ব্রায়ান লারা এবং শচীন টেন্ডুলকার। সংখ্যাটা আরও বাড়ানো যেত। কিন্তু তাহলে আলচনার ফোকাস নষ্ট হবে। তাছাড়া সাধারণ ক্রিকেট প্রেমী থেকে আরম্ভ করে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ – সবার কাছেই এই চারটি নামের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তেমন সংশয় থাকার কথা নয়।

এই লেখায় তাদের টেস্ট ক্যারিয়র নিয়েই মূলত আলোচনা করব। চারজনেরই গড় ৫০এর ওপর – গ্রেট ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে যেটাকে অলিখিত বেঞ্চমার্ক হিসেবে ধরা হয়। চারজনেই একশোর ওপর টেস্ট খেলেছেন। অর্থাৎ কয়েকটি টেস্টের অত্যাশ্চর্য ভালো রেকর্ড বা ব্যর্থতা তাদের সামগ্রিক ক্যারিয়রে তেমন প্রভাব ফেলবে না।

এই চারজন ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ার আমরা ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেখব। মূল উদ্দেশ্য তাদের ধারাবাহিকতা, পিক ফর্ম, ব্যাড প্যাচ ইত্যাদির সম্বন্ধে ধারণা করা।

  • ১ থেকে ২০ টেস্ট

সানির আরম্ভ এই চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ফোরক। তুলনায় শচীন মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিজের প্রতিভায় ক্রিকেট বিশ্বকে হতচকিত করলেও, পরিসংখ্যানে খানিক পিছিয়ে। চারজনের মোট রান ও গড় দিলাম।

সানি – ১৭৩৩, ৫০.৯৭

ভিভ – ১৮৯০, ৫৭.২৭

লারা – ১৮২৮, ৫৫.৩৯

শচীন – ১০৮৫, ৩৭.৪১

মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম সিরিজের অতিমানবিক রান ও গড় সত্বেও সানি কিন্তু চারজনের মধ্যে তৃতীয় স্থানে। এবং প্রথম সিরিজ বাদ দিলে তার গড় সচিনের চেয়েও নিচে নেমে আসবে।

ভিভ এবং লারা – দুজনেরই প্রথম সেঞ্চুরি বেশ বড় সাইজের (লারার আবার ডাবল সেঞ্চুরি)। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে তারা আরম্ভ থেকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্যে তৈরি ছিলেন। তুলনায় শচীন ধীরে ধীরে উন্নতি করেন, পরিণত হন। তার বয়সের কথা চিন্তা করে সম্ভবত তাকে এই সময়টা দেওয়া যেতে পারে।

  • ২১ থেকে ৪০ টেস্ট

সানি – ১৯৪০, ৫২.৪৩

ভিভ – ১৭৩৯, ৬৪.৪১

লারা – ১৮৫৯, ৫৬.৩৩

শচীন – ১৫৭৫, ৭১.৫৯

এই পর্যায়ে সবাই অসাধারণ পারফর্ম করেছেন। সানি প্রমান করেন যে তার প্রথম সিরিজের সাফল্য ফ্লুক ছিল না। ভিভ নিজের বিধ্বংসী ফর্ম বজায় রেখেছেন।

লারা আরম্ভের ৪০ টেস্ট জুড়ে অসম্ভব ধারাবাহিকতা দেখান। এবং শচীন অবশেষে প্রমান করেন যে তিনি নিছক বয় ওয়ান্ডারের তকমায় সন্তুষ্ট থাকার জন্য ক্রিকেট বিশ্বে পা রাখেন নি।

  • ৪১ থেকে ৬০ টেস্ট

সানি – ১৯৭৪, ৬৫.৮০

ভিভ – ১১৭২, ৪৩.৪০

লারা – ১২৩৮, ৩৬.৪১

শচীন – ১৬৮৪, ৫৬.১৩

এবার সানি শীর্ষে। পেছনেই শচীন। দুই প্রজন্মের দুই লিটল মাস্টার। এবং দুই ক্যারিবিয়ান মাস্টার ব্লাস্টার কিঞ্চিত নিস্প্রভ। ভিভের গড় তবুও সম্মানের, লারা যেন কিছুটা অফ ফর্মে।

কিন্তু চ্যাম্পিয়নদের রাইট অফ করবেন না। হতে পারে দিস ইজ দ্য সাইলেন্স বিফোর দ্য স্টর্ম।

  • ৬১ থেকে ৮০ টেস্ট

সানি – ১৩৮৭, ৪৭.৮৩

ভিভ – ১১৯৬, ৪৭.৮৪

লারা – ১৬০৮, ৪৩.৪৬

শচীন – ২২১৩, ৬৭.০৬

ঝড় এল, তবে ক্যারিবিয়নের সমুদ্রসৈকত থেকে নয়, মুম্বাইয়ের সমুদ্রকুল থেকে। এই প্রথম চারজনের মধ্যে ২০ টেস্টের ব্লকে কেউ ২০০০ রানের গণ্ডি পেরলেন, অন্য তিনজনের চেয়ে প্রায় ২০ গড় বেশি নিয়ে। লারা কিছুটা ইম্প্রুভ করলেও তার ফ্যানদের কপালে এখনও দুশ্চিন্তার ছায়া। বয় ওয়ান্ডার এখন মাস্টার ব্লাস্টারে পরিণত।

  • ৮১ থেকে ১০০

সানি – ১৪৪৫, ৪৫.১৬

ভিভ – ১৩৩৯, ৪৯.৫৯

লারা – ২৩৮৩, ৭০.০৯

শচীন – ১৮৪৮, ৫৯.৬১

শচীন এই পর্বেও অসাধারণ। কিন্তু লারা যেন অন্য গ্রহের প্রাণী। অর্থাৎ ক্যরিবিয়ন সমুদ্রসৈকত থেকেও অবশেষে ঝড় উঠল। ভিভ এবং সানি দুজনেই সম্মানজনক।

  • ১০১ থেকে ১২০

সানি – ১৩৪৩, ৪৬.৩১

ভিভ – ১১৪৪, ৩৯.৪৫

লারা – ২০৪৫, ৫৮.৪২

শচীন – ১৪৭৪, ৫৪.৫৯

লারার শেষটাও যথেষ্ট ধামাকেদার। শচীন সামান্য পেছনে। ভিভের রিফ্লেক্স কমে যাওয়ার প্রভাব স্পষ্ট। এবং সানি যথারীতি এখনও নির্ভরযোগ্য।

ভিভ, সানি, লারা এবং শচীন যথাক্রমে ১২১, ১২৫, ১৩১ ও ২০০ টেস্ট খেলে নিজের ক্যারিয়র শেষ করেন। তাই তুলনার সুবিধের জন্য প্রত্যেকের ক্যারিয়ারের প্রথম ১২০ টেস্ট বেছে নিয়েছি।

এই ১২০ টেস্টের পর আলোচিত চারজনের গড় এইরকম – সানি – ৫১.৪২, ভিভ – ৫০.৪৬, লারা – ৫৩.২১ এবং শচীন ৫৭.৪৪। অর্থাৎ সবচেয়ে স্লো স্টার্ট করেও শচীন শীর্ষে। সানি ওপেনিং করার জন্যে নি:সন্দেহে কিছু এক্সট্রা পয়েন্ট দাবী করতে পারেন। ভিভ নিজের বিধ্বংসী মেজাজের জন্য। লারার ব্যাটিঙে একই সঙ্গে ধ্বংস এবং সৃষ্টির সমাবেশ – চারজনের মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ছিল তাঁর ব্যাটিং।

এবং শচীন?

বয় ওয়ান্ডার হিসেবে কিছুটা ঢিমেতালে শুরু করেও চারজনের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থান দখল করেন। প্রথম ২০ টেস্ট বাদ দিলে আর কোন ব্লকেই তার গড় ৫০এর নিচে নামে নি। এই ১০০ টেস্টে তার মোট রান ৮৭৯৪, গড় ৬১.৫০। এই ধারাবাহিকতা চারজনের মধ্যে আর কারও নেই। এই ব্যাপারে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সুনীল গাভাস্কার। তার আবার আরম্ভ থেকেই প্রত্যেক ব্লকে গড় ৪৫এর ওপরে।

ভিভ যেখানে শেষ করেন শচীনের ক্যারিয়রের প্রায় ৪০% ক্রিকেট খেলা তখনও বাকি। পরবর্তী ৮০ টেস্টে ৪৮.৭৩ গড়ে ৬০৪২ রান করেন শচীন। তবে শেষ কিছুদিন তার ফর্ম ভালো ছিল না। যদি জানুয়ারি ২০১১ অব্দি খেলে শচীন অবসর নিতেন তাহলে তার রেকর্ড আরও অনেকটাই ভালো হত। তখন হয়ত এই ধরনের লেখার প্রয়োজনই থাকত না।

আজকাল স্টিভেন স্মিথকে নিয়ে প্রায়ই দেখি লেখা হয় – গ্রেটেস্ট সিন্স ব্র্যাডম্যান। তা আমাদের শচীনেরও প্রথম কুড়ি আর শেষের ২৩ টেস্ট বাদ দিলে ক্যারিয়ারের হিসেব দাঁড়াচ্ছে এই রকম – ১৫৭ টেস্ট, ১৩৬০৭ রান, গড় ৫৯.৪২।

পরপর ১৫৭ টেস্টে এই ধারাবাহিকতা যদি স্টিভ দেখাতে পারে তাহলে তাকে শচীনের পাশে বসানোর কথা ভাবা যেতে পারে। তারপর না হয় পিচের ও বোলিঙের কোয়ালিটি, ১০০ কোটি ভক্তের চাপ, চতুর্থ ইনিংসের গড়, ক্রিকেট খেলার নিয়মের রদবদলের মতো সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ‘গ্রেটেস্ট সিন্স ডন’ বিতর্কের সুরাহা করার চেষ্টা হবে।

এবার আপনাদের আউট স্যুইং, লেগ স্পিন, দুসরা আর বাউন্সারের পালা। আরম্ভ হোক। শচীন তৈরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link