২০০৫ সালের ঘটনা। প্রথমবারের মতো গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অনুশীলন চলছিল স্টেডিয়ামে। আর স্টেডিয়ামের বাইরে তাঁদের বিরুদ্ধে চলছিল একঝাঁক মানুষের মিছিল। দাবি ছিল একটাই- মেয়েদের ফুটবল খেলা চলবে না কিছুতেই।
সেদিন স্টেডিয়াম থেকে অনুশীলন শেষে বাইরে যাবার সময় সাবিনা, তৃষ্ণা, অম্রাচিংদের কিছু সতর্কতা অবলম্বনে বারবার সতর্ক করা হয়। বাসের ভেতর কেউ যেন ভুলেও মাথা না তুলে, বাইরে থেকে যেন কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে যে বাসের ভেতর খেলোয়াড়রা আছেন। এভাবে একপ্রকার পালিয়েই ওইদিন মাঠ ছাড়তে হয় আমাদের নারী ফুটবলারদের।
আতঙ্কে লুকিয়ে-পালিয়ে সেদিন মাঠ ত্যাগ করা বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল একটু আগে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরল। ওই শুরুর দলের কেবল একজন রয়েছেন আজকের চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলে। তিনি দলের অধিনায়ক এবং এবারের সাফের সর্বোচ্চ গোল স্কোরার সাবিনা খাতুন। যদিও এই দলের বাকিরাও ফুটবল খেলতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ব্যক্তিগতভাবে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন। সেসব ঘটনা নানা সময় পত্রপত্রিকায়ও এসেছে। আজকের শুভ দিনে তাই সেগুলো মনে না-ই বা করলাম!
মূলত এসব প্রতিকূলতা জয় করতে করতেই বাংলাদেশের লেগে যায় ৭-৮ বছর। তারপর আসে যে কোনো পর্যায়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবলারদের প্রথম সাফল্য। ২০১৫ সালে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ নারী আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। তবে ওই টুর্নামেন্টটাও ছিল আমাদের মেয়েদের জন্য এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা৷ ফাইনালের আগে ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে যারপরনাই আতঙ্কিত সবাইকে হোটেলের বাইরে গোটা রাতটা কাটাতে হয়। ওই সময়টায় পুরো দলের সদস্য এবং তাঁদের পরিবার একটা বড়ো ধরণের ট্রমার মধ্য দিয়ে যায়। পরেরদিন টুর্নামেন্ট স্থগিত হওয়ায় শারীরিকভাবে সুস্থ অবস্থায় বিশেষ বিমানে করে দেশে ফিরে আসে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দল। আর সে বছরই ডিসেম্বরে ফাইনাল ম্যাচে মার্জিয়ার একমাত্র গোলে নেপালকে হারিয়ে শিরোপা বাগিয়ে নেন তাঁরা।
এটাই ছিল বাংলাদেশ নারী ফুটবল জাগরণের প্রথম ধাপ। এর একটা বড়ো কৃতিত্ব ২০১১ সাল থেকে চালু হওয়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের, যেখান থেকে ওঠে আসা ফুটবলাররাই মূলত প্রতিনিধিত্ব করেন ওই চ্যাম্পিয়ন দলটার। আজ অবধি অসংখ্য নারী ফুটবলার ওঠে এসেছেন এ টুর্নামেন্টটার মাধ্যমে যাঁদের মধ্যে মারিয়া, সানজিদা, কৃষ্ণা, মার্জিয়া, শামসুন্নাহার জুনিয়র, স্বপ্না, মৌসুমী, তহুরারা উল্লেখযোগ্য।
এরপর থেকে আর তাঁদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁদের হাত ধরেই বয়সভিত্তিক ফুটবলে আসতে থাকে একের পর এক সাফল্য। ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ নারী আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপেও দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের শিরোপা ধরে রাখেন তাঁরা। খেলেছেন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে। সেইসাথে জিতেছেন ২০১৭ অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৮ চারজাতি জকি কাপ, ২০১৮ সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৯ বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ গোল্ড কাপ এবং ২০২১ সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা।
এ সবগুলাই ছিল বয়সভিত্তিক দলের সাফল্য। কিন্তু কোনোভাবেই সেটা জাতীয় দলে টেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। বয়সভিত্তিক দলগুলার এতসব অর্জনের মাঝে জাতীয় দল কেবল ২০১৬ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হয়েছিল।
অবশেষে ২০২২ সালে এসে বয়সভিত্তিক দলের নিয়মিত সফলতাগুলোর সুফল ভোগ করতে পারল বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। কিছুক্ষণ আগে শামসুন্নাহার জুনিয়রের এক এবং কৃষ্ণা রানি সরকারের জোড়া গোলে নেপালকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো শিরোপা হিসেবে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিলো বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
ফুটবল খেলুড়ে দেশ হিসেবে আমরা সবশেষ সাফ টুর্নামেন্ট জিতেছিলাম দীর্ঘ ১৯ বছর পূর্বে, পুরুষ দলের হাত ধরে। সেদিন আমার সবসময়ের সবচেয়ে প্রিয় বাংলা ধারাভাষ্যকার প্রয়াত খোদা বক্স মৃধা একটা কথা বলেছিলেন। আজ এই অর্জনে সে কথাটা তাঁর কাছ থেকে ধার করে না বললেই নয়- এ জয় বাংলাদেশের জয়। এ জয় ফুটবলের জয়। অভিনন্দন গোলাম রাব্বানী ছোটনকে! অভিনন্দন আমাদের মেয়েদের!