ক্রিকেটটা এই অঞ্চলে স্রেফ খেলার চেয়েও অনেক বড় ব্যাপার। ভারতীয় উপমহাদেশের বাকি দেশগুলোর মত বাংলাদেশেও জনগণের জীবনের একটা বড় জায়গা দখল করে আছে ক্রিকেট৷ অধিকাংশ বাংলাদেশি শিশুর শৈশব কেটে যায় শহরের গলি আর গ্রামের উঠোনে ব্যাটবল হাতে৷
কিছু ছেলেশিশুর ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন পূরণ হলেও সামাজিক প্রথার জন্য অঙ্কুরেই ঝরে যায় বেশিরভাগ মেয়েশিশুর ক্রিকেট প্রতিভা৷ যে কজন হাতে গোণা নারী এই প্রথা ভেঙে এগিয়ে এসেছেন তাদের একজন সালমা খাতুন, যাঁকে পুরো বিশ্ব আজ চেনে বাংলাদেশ প্রমীলা ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার হিসেবে।
সাধারণ এক গ্রামীন কিশোরী থেকে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হবার যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিলোনা। খুলনার মিলকি দেয়াড়া গ্রামে জন্ম সালমার। বাবা ছিলেন খুলনা শিপইয়ার্ডের কর্মচারী। তিনি ছোট থাকতেই স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যা নেন বাবা। চার ভাইবোনের অভাবের সংসারে তাই অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়া হয়ে ওঠেনি সালমার৷
কিন্তু, তাতে ভাটা পড়েনি ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসায়৷ খালি পায়ে কোমরে ওড়না গুঁজে প্রায়ই নেমে যেতেন ক্রিকেট খেলতে৷ কাঠের আসল ব্যাট কেনা সম্ভব ছিলোনা, তাই নারকেল গাছের চওড়া গুড়ি ছিলো তাঁর ব্যাট। এগারোজনের দলে একটি মাত্র নারী খেলোয়াড়, গ্রামের মানুষজনের কাছে দৃষ্টিকটু ঠেকতো৷ তবে সেসব কিছুতেই গা করতেন না সালমা। মাথার ওপর ছায়া হয়ে ছিলেন সংগ্রামী মা আর উৎসাহ জুগিয়ে যেতেন মামারা। সেই সাথের নিজের সহজাত ক্রিকেট প্রতিভা তো ছিলোই। তিনের মেলবন্ধনে সালমা ডাক পেয়ে যান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকে।
২০০৮ সালে তিনি প্রথমবার ঢাকা আসেন ধানমন্ডিতে বিসিবির সিলেকশনে অংশ নিতে৷ সেখানেই তাঁকে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট নারী দলের অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। অপ্রত্যাশিত সাফল্যে উচ্ছ্বাসিত হয়ে পড়লেও সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অভাব। বুট ক্যাম্পের জন্য মালয়েশিয়া যেতে হবে দলের সাথে। কিন্তু ব্যাট-বল-গ্লাভস আর অন্যান্য সামগ্রী কেনার মত অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিলোনা তাঁর পরিবারের। শেষমেশ এগিয়ে আসেন তাঁর দুলাভাই। দুলা ভাইয়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান তিনি৷
গ্রামের আনাড়ি হাতের ব্যাটসম্যান থেকে আজকের সালমা হয়ে ওঠার পেছনে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু৷ এই প্রশিক্ষকই নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন সালমাকে। এমনকি সালমার প্রথম ব্যাটটিও তাঁরই দেয়া৷ এছাড়াও ক্যারিয়ারের পুরো সময় জুড়ে তাঁর সাথে ছিলেন আরো একজন কোচ এহসানুল হক।
সালমার হাত ধরে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ওয়ানডে যাত্রা শুরু হয়৷ এমনকি বাংলাদেশের একমাত্র এশিয়া কাপটিও এসেছে তাঁর হাতেই৷ ২০১১ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর এখন পর্যন্ত ওয়ানডে দলের অধিনায়ক ছিলেন আট বছর। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক হিসেবে। নয় বছরের ক্যারিয়ারে ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন ৩১টি, রানসংখ্যা ৩৫৮। অন্যদিকে ৪০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে রান করেছেন ৪৬৮৷ তাছাড়া নারী খেলোয়াড়দের র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের খেতাবও অর্জন করেছেন তিনি।
এতসব সাফল্যের পরও সালমা ও তাঁর দল অনেকটা বঞ্চিতই বলা যায়। ছেলেদের ক্রিকেটের দিকে বিসিবির যতটা মনোযোগ, মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি যেন ততটাই অবহেলা। বেতন ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার দিক দিয়েও অনেকটা পিছিয়ে আছে নারী ক্রিকেট দল। তবে সম্প্রতি এশিয়া কাপে সাফল্যের পর কর্তৃপক্ষের নজর কিছুটা ঘুরেছে। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের প্রতিও এখন মনোযোগ দিচ্ছে বিসিবি।
আগের চেয়ে এখনকার মেয়েরা ক্রিকেটের প্রতি বেশী আগ্রহী। সামাজিক বাঁধার দেয়াল পেরিয়ে অনেকেই এখন এগিয়ে আসছেন খেলায়৷ এমনকি পরিবারগুলোও প্রতিভাবান মেয়েদেরকে ক্রীড়ায় অংশগ্রহণের জন্য যথেষ্ট উৎসাহ যোগাচ্ছে। আর ক্রিকেটে আসা নারীদের অনুপ্রেরণা সালমা খাতুনরা।