আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেট যেই স্তম্ভ গুলোর উপর দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করে তাঁদের একজন তিনি। জীবনের প্রায় ৬০ টি বছর ভারতের ক্রিকেটের বিভিন্ন স্তরে দিয়েছেন। ভারতের ক্রিকেটের একদম শুরুর দিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ব্যাট হাতে একটা ট্রেডমার্ক রেখে গিয়েছিলেন। বল হাতেও ছিলেন অনন্য। শুধু বোলিং আর্মটা বেইমানী না করলে ভারতের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হতে পারতেন। তবুও চাঁদু বোর্দে ক্রিকেটের নিবেদিত প্রাণ। জীবন আর ক্রিকেট যেখানে মিলেমিশে একাকার।
১৯৩৪ সালে পুনের এক মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চাঁদু বোর্দে। বোর্দেরা ছিলেন মোট দশ ভাইবোন। তাঁর ছোট ভাই রামেশও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছিলেন। তবে বোর্দের জন্মই হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়ার জন্য।
১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে বারোডার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন। সেবছরই তখনকার শক্তিশালি দল বোম্বের বিরুদ্ধে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি করেন। তবে ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে অলরাউন্ডার বোর্দেকে পুরোপুরি দেখা যায়। সেই আসরের ফাইনাল ম্যাচে একটা হাফ সেঞ্চুরির পাশাপাশি নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট।
১৯৫৮ সালে ভারতের সবচেয়ে সম্ভাবনমায় ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট দলে ডাক পান বোর্দে। মুম্বাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক টেস্ট ম্যাচে অভিষিক্তও হন তিনি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। নিজেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পরিচয় করান ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে করেন ১০৯ রান। দিল্লি টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও বোর্দের ব্যাট থেকে আসে ৯৬ রান।
এরপর থেকে ভারতের ব্যাটিং লাইন আপের মূল ভরসা হয়ে ওঠেন বোর্দে। তবে ১৯৬১-৬২ সালে অলরাউন্ডার বোর্দেকে দেখে ক্রিকেট বিশ্ব। ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট জয়ে দারুণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। ইডেন গার্ডেন্সে ব্যাট হাতে যথাক্রমে করেন ৬৮ ও ৬১ রান। এছাড়া বল হাতেও ওই ম্যাচে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। পরের টেস্টেও পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন বোর্দে।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ সফল ছিলেন এই ব্যাটসম্যান। ১৯৬৪ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন তিনি। ওই সিরিজে ৬০.৮১ গড়ে মোট ৩৭১ রান করেছিলেন বোর্দে। এরপরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও দুটি সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। বল হাতেও সুভাষ গুপ্তের সাথে সেই সময় দারুণ জুটি বেধেছিলেন বোর্দে। বোর্দের লেগ স্পিনে নিয়মিতই উইকেট পেত ভারত। ফলে ব্যাট-বল দুই ডিপার্টমেন্টেই ভারতের মূল ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছিলেন এই ক্রিকেটার।
তবে কাঁধের ইনজুরির কারণে ১৯৬৪ সালের পর আর বল করতে পারেননি তিনি। ফলে অসাধারণ এক অলরাউন্ডারকে হারায় ভারত। তবে ব্যাট হাতে পুরো ষাটের দশক ভারতকে সার্ভিস দিয়ে গিয়েছেন তিনি। এছাড়া আউট ফিল্ডে সেইসময় ভারতের অন্যতম সেরা ফিল্ডার ছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে ক্রিকেট মাঠের দারুণ এক প্যাকেজ ছিলেন চাঁদু বোর্দে।
ভারতের হয়ে খেলা ৫৫ টেস্টে তাঁর ঝুলিতে আছে ৩০৬১ রান। পাঁচটি সেঞ্চুরি সহ খেলেছিলেন ১৭৭ রানের সর্বোচ্চ ইনিংস। ক্যারিয়ারের লম্বা সময় বল করতে না পারলেও এই লেগ স্পিনার নিয়েছিলেন ৫২ টি উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১২৮০৫ রানের পাশাপাশি তাঁর ঝুলিতে আছে ৩৩১ উইকেট।
১৯৬৬ সালে ভারতের চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে পেয়েছিলেন অর্জুন পদক। ১৯৬৯ সালে পদ্মশ্রী পুরষ্কারেও ঘোষিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর নির্বাচক, ম্যানেজার, কোচ, পিচ কিউরেটর কিংবা বিসিসিআই এর বিভিন্ন পদে থেকে ক্রিকেটের জন্য কাজ করে গিয়েছেন এই অলরাউন্ডার।
১৯৮৩ বিশ্বকাপের দল গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। ১৯৮৪ ও ১৯৯৯ সালে মোট দুইবার ভারতের নির্বাচক কমিটির সভাপতি হন তিনি। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন সফরে ম্যানেজার হিসেবেও ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে নেহেরু স্টেডিয়ামের পিচ কিউরেটরের দায়িত্বও নেন চাঁদু বোর্দে। আজ ৮৭ বছর বয়সে এসেও ক্রিকেট থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারেননি তিনি। বয়স তাঁর কাছে শুধুই সংখ্যা, আর ক্রিকেট? সে তো প্রথম প্রেম!